“একবার হয়ে যাবে ধান আর গান

সাগরে পাহাড়ে বনে

আলো দিয়ে লেখা হবে মানুষের নাম 

অর্থ পাবে সব ভালোবাসা

এক হাঁটু জলে ডুবে যাবে নাতো এক বুক আশা, 

আমাদের এত মেধা এত শ্রম ঢালার গৌরবে

আজ নয়, কালও নয়, 

যা চেয়েছি-একদিন হবে।”

-এই একদিন সব হওয়ার আশা আশাবাদী কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের কণ্ঠের সুরের প্রকাশিত। একই সঙ্গে সে সুরে প্রকাশ পায় কবির ‘আবেগী দীপ্ততা’ও আত্মসচেতন মানসিকতা। কবির এই আত্মচেতন মননে যেমন আবর্তিত হয়েছে নিঃসাড় সময়ের ধোঁয়াশা তেমনি সেই সময় চেতনা থেকে এক আশাবাদী জীবন বোধও কবিকে তাড়িত করেছে। একই সঙ্গে স্বদেশপ্রেমের এক শুভ চেতনা কবির কাব্য দেহে ব্যাপ্তি লাভ করেছে।

কবিতার নাম ‘আমার নাম ভারতবর্ষ। জন্মভূমি ভারতবর্ষ কবির কাছে এক সময় প্রেমিক ধরা দিয়েছিলো—

‘আমার প্রেমিকাই আমার দেশ

রাহুর মতো আমার প্রচণ্ড ভালোবাসা

যখন তার ভেতর ধরে টান দেয় 

দেখি,

সারা গোধূলির আকাশ বন্দী হয়ে আছে”

—এই প্রেমিকা রূপিণী একান্ত ভলোবাসার ধন ভারত ভূমির হাসি-কান্না, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সঙ্গে কবির এক গভীর নাড়ীর যোগ। তাই প্রেমিকা ভারতবর্ষকে যখন পুঁজিপাতি রাক্ষসরা ভাগ করে নিতে চায়, লুটতে চায় তার সর্বস্বকে, স্টেনগানের গুলিতে যখন তারা ঝাঁজরা করে। ভারতের বক্ষদেশ তখন কবি গর্জে ওঠেন। ভারতমাতার জবানিতে কবি তাই কবিতার সূচনাতে বলেন—

“স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে 

আমার ঝাঁজরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র

তার নাম ভারতবর্ষ”

শুধু অমিতাভর ভারতবর্ষের বুকে বুলেট চলেছে তাই নয়, একই বুলেট চলতে দেখা গেছে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমার ভারতবর্ষের বুকেও—

‘গুলি চলছে, গুলি চলছে, গুলি চলছে-এই না হলে শাসন?

ভাত চাইলে গুলি, প্রতিবাদ করলে গুলি

আসলে কবিরা তো দায়বদ্ধ শিল্পী। সমাজের বুকে-দেশের বুকে ঘটে যাওয়া তাণ্ডব কেকি তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন ? তাই অমিতাভ কবির ক্ষেত্রেও সমাকালীন সমাজ-জীবন, রাষ্ট্রীয় ভাঙা-গড়া, রাজনৈতিক ডামাডোল, শোষণ বঞ্চনা, অত্যাচারের জ্বলন্ত উত্তাপ অন্যান্য কবিতার মতো আলোচ্য কবিতাকেও সেঁকে দিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনের ভয়াবহ আক্রমণের ছবি, ৬২-এর চীন-ভারত দ্বৈরথ, ৬৬-এর খাদ্য আন্দোলন, ৬৯-এর যুক্তফ্রন্টের পতন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, ৭৫-এর গণতন্ত্রের হত্যা—প্রভৃতি ঘটনাবলী ৮২-তে প্রকাশিত। আমি তোমাদেরই লোক’ কাব্য গ্রন্থে কবিতালীতে যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করবে একথা বলাই বাহুল্য। আলোচ্য কবিতা ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ও একই সূত্রে কবির পূর্বোক্তি অভিজ্ঞা ঋদ্ধ।

সমালোচক সুশান্ত বসু ঠিকই বলেছেন— “একাধিক মানুষের প্রতি অবিচল এক গভীর বিশ্বাস অন্যদিকে অস্থির অনিকেত এক এলোমেলো জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে চটকল শ্রমিকের বস্তিতে, তাদের ধর্মঘটী জীবনের সহযাত্রায়, মার্জিত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পদযাত্রায় আর উদ্যোগে, উত্তর বাঙলার আনাদৃত নিরন্ন শ্রমজীবী মানুষদের দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার অন্তরঙ্গ সহমর্মী শরিক করে তুলেছে তাঁকে।”

শ্রমজীবী মানুষের কবি অমিতাভ তাই বলে একক কেন্দ্রিক নন বরং বহুমাত্রিক। তাই তাঁর কবিতায় যেমন শোনা যায় বীজবোনার গান, চা-বাগিচার গান, কয়লা খননের গান তেমনি শোনায় পাহাড়-অরণ্যের ভালোবাসার গান— 

“আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে

চা-বাগিচায় কফি খেতে,

কয়লা খাদ্যদানে, পাহাড়ে অরণ্যে

লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা

তার নাম ভারতবর্ষ।”

আসলে কবির ভারতবর্ষ শ্রমিকের ভারতবর্ষ, যারা ‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে শুধুই কাজ করে যায়। যাদের ‘অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ’ বোনা হয়েছে অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন—এটাই কবির ভারতবর্ষ। এখানেই—

‘এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে

ভাকুরা নাঙালের পাথুরে কাঁধের গম্ভীর ছায়া।’

এখানেই—

‘ডিগবয়ের বুক থেকে

মায়ের দুধের মতো উঠে আসা ঢেলে ভেসে যাচ্ছে

আমার সারা শরীর।

এই ‘ভাকরা নাঙালে’র বা ‘ডিগবয়ে’র শ্রমিকরাই কবির ভারতবর্ষকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আবার এই শ্রমিকরাই স্বার্থন্বেষী পুঁজিপতি সমাজের তৈরি দাঙ্গায় রক্তাক্ত মানুষগুলিকে শুশ্রুষা করেছে। এরা তো প্রকৃতই পৃথিবীর ‘হালবহনকারী বলরাম’। এই ভারতবর্ষেই কবি দেখেছেন—’প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর/শোক নয় ক্রোধের আগুনে/দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে।

কবি ‘নিজের কথা’য় লিখেছিলেন—’আমার বিশাল দেশের দিশেহারা মানুষের কষ্ট আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই হিমালয় প্রতিম দুঃখ-কষ্টের ওপর নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট স্থাপন করে দেখেছি, তা কত অকিঞ্চিৎকর, তা কত বানানো।

দেশের এই দীশাহারা মানুষের কষ্টে কবি অশ্রুপাত করেছেন আন্তরিকভাবে আবার ‘চা বাগানে, কয়লাখনিতে, পাহাড়ে, অরণ্যে শ্রমিক, কৃষক, মজুর-এর বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণায় তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংগ্রামে কবি মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর সংগ্রামের রক্তকণা, সহানুভূতির অশ্রুবিন্দু, ভালোবাসার সহমর্মিতা। তাইতো কবি দেখতে পান—

‘ভরাট গর্ভের মতো

আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।

বৃষ্টি আসবে।

ঘাতকের স্টেনগান বরফগলা গঙ্গোত্রীর মতো ছুটে আসা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী জনতার সামনে স্তব্ধ হয়ে যাবে। প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর/কানায় কানায় ভরে উঠবে? ভরে উঠবে গ্রাম-গ্রামান্তর মানুষের প্রতিবাদের জয়ধ্বণিতে।

‘প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুজ চুম্বনে।

ওড়িশির ছন্দে ভারত নাট্যমের মুদ্রায়

সাওতালি মাদলে আর ভাঙবার আলোড়নে

জেগে উঠবে তুমুল উৎসবের রাত।

ভারতবর্ষ নতুন রূপে-রঙে ভরে উঠে তিলোত্তমা হয়ে উঠবে। সমাজ হয়ে উঠবে শোষণ মুক্ত। সাম্যবাদী বৃষ্টিতে সমাজ ধৌত হয়ে ঘুঘু স্বাভাবিক জীবনের রঙিন স্বপ্নে মানুষ বিভোর হবে। আর নগরে প্রান্তরে ‘মাইল মাইল’ ভালোবাসা বিরাজ করবে। আর এই ভালোবাসার নাম—

‘স্বদেশ

স্বাধীনতা

ভারতবর্ষ।

আমার নাম ভারতবর্ষ

এভাবেই কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত ‘আমার নাম ভারতবর্ষ কবিতায় দেশজ রাজনীতির তথা ইতিহাসের অন্ধকারময় সময়কে দূরে ঠেলে আশাবাদের সুর শোনালেন, সুর শোনালেন শুভ শক্তি জাগরণে। আর এই সূত্রেই কবির স্বদেশ প্রীতির বলিষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেল এ কবিতায়।