আমলাতন্ত্রের আলোচনা সাম্প্রতিককালের বিষয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেও জনপালন কৃত্যক বা আমলাতন্ত্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ইংল্যাণ্ডে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয়। তাই বলা হয় যে আমলাতন্ত্র হল ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যাণ্ডে শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক উদ্ভাবন। ওয়ালাস তাঁর The Process of Government গ্রন্থে বলেছেন: “The creation of this service is one of the great political invention in this nineteenth century England.” ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যে সমস্ত গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে সেগুলিতে আমলাতন্ত্রের আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে। লাওয়েলের Government of England প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। এই গ্রন্থে প্রথম রাষ্ট্রকৃত্যক ‘বা আমলাদের সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে।
আমলাতন্ত্রের অর্থ
আমলাতন্ত্র কাকে বলে? আমলাতন্ত্রের কোন সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করা সহজ নয়। রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের নিয়ে শাসন-বিভাগের যে সকল স্থায়ী কর্মচারী থাকেন তাঁদের সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রকৃত্যক (Civil Servants) বলা হয়। বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই সকল স্থায়ী কর্মচারিগণ ‘আমলা’ (Bureaucrat) হিসাবে অধিক পরিচিত। এঁদের দ্বারা পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ‘আমলাতন্ত্র’ (Bureaucracy) নামে অভিহিত হয়। রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থায় আমলারা হলেন সরকারের অ-রাজনীতিক (non-political) অংশ। জনকল্যাণমূলক তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, সামাজিক ও আর্থনীতিক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রভৃতি বহুবিধ জটিল সমস্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সরকারের দায়-দায়িত্ব অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসনিক কলাকৌশলের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাব-হেতু মন্ত্রিমণ্ডলী বা রাজনীতিক প্রশাসকগণের পক্ষে সকলক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না। ফলে তাঁরা শাসন-বিভাগের স্থায়ী কর্মচারী বা অ-রাজনীতিক অংশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্য বহুলাংশে স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের উপর নির্ভরশীল। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “Every state is enormously dependent upon the quality of its public officials.” তাই প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাদের ভূমিকার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। তাই প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনানুসারে এবং নিয়মিত প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্থায়ী সরকারী কর্মচারী বা আমলাগণ থাকেন।
আমলাতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
অনেক ক্ষেত্রে নিন্দাসূচক অর্থে ‘আমলাতন্ত্র’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ‘আমলাতন্ত্র’ শব্দটির সঙ্গে একটি বিকৃত ধারণা বা নিন্দাসূচক অর্থ জড়িয়ে আছে। আমলাতন্ত্র বলতে এখন সরকারী কর্মচারীদের প্রশাসনিক নিয়মকানুনের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, দীর্ঘসূত্রতা, অনমনীয়তা, দপ্তর ঘেঁসা মানসিকতা, ঔদাসীন্য, স্বেচ্ছাচারিতা, সৌজন্যবোধ ও মানবিকতার অভাব প্রভৃতি ধারণার কথা মনে আসে। বস্তুত আমলাতন্ত্র হল একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা যার দ্বারা সরকারী প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শব্দগত বিচারে আমলাতন্ত্র বা ইংরেজী ‘ব্যুরোক্রেসী’ (Bureaucracy) শব্দটি ফরাসী শব্দ ‘ব্যুরো’ (Bureau) এবং গ্রীক শব্দ ‘ক্রেটিন’ (Kratein)-এর সমাহারে সৃষ্ট। লেখার টেবিল বা ডেস্ক (desk) অর্থে ‘ব্যুরো’ এবং শাসন অথে ‘ক্রেটিন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে আমলাতন্ত্র বা ‘ব্যুরোক্রেসী’ হল ‘টেবিল-শাসনব্যবস্থা’ (desk-government)। তবে বর্তমানে এক একটি দপ্তর অর্থেও ‘ব্যুরো’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই দিক থেকে আমলাতন্ত্র অর্থে বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে শাসন পরিচালনাকে বোঝানো হয়।
রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক প্রশাসক: বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ দুটি অংশে বিভক্ত। এই দু’টি অংশ হল রাজনীতিক প্রশাসক (Political Executive) ও অ-রাজনীতিক প্রশাসক (Non-Political Executive)। এই অ-রাজনীতিক প্রশাসকদের রাষ্ট্রকৃত্যক বা জনপালন কৃত্যক (Civil Service) বলে। রাজনীতিক প্রশাসক বলতে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী প্রভৃতি পদাধিকারীদের বোঝায়। এঁরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হন এবং এই রাজনীতিক প্রশাসকগণ তাঁদের কাজকর্মের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন। শাসন-বিভাগের অ-রাজনীতিক অংশ বলতে প্রশাসনিক কাজে স্থায়িভাবে নিযুক্ত সরকারী কর্মচারীদের (Permanent Executive) বোঝায়। এঁদেরই রাষ্ট্রকৃত্যক বা জনপালন কৃত্যক (Civil Service) বলা হয়। আশিরবথম তাঁর Political Theory গ্রন্থে বলেছেন: “The civil service constitutes the permanent executive in modern state. While the Parliament, the Cabinet and the President may reign, it is the civil service which really governs.” এই রাষ্ট্রকৃত্যক বা জনপালন কৃত্যকই হল আধুনিক রাষ্ট্রের স্থায়ী শাসন-বিভাগ। দেশের প্রকৃত শাসন পরিচালনার দায়িত্ব এঁদের উপরই ন্যস্ত থাকে। এই রাষ্ট্রকৃত্যক, বিশেষত পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের ‘আমলা’ (Bureaucrat) বলে। আর ‘আমলাতন্ত্র’ হল আমলাদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা।
আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন সংজ্ঞা:
প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিয়মিতভাবে এবং আইনানুসারে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য স্থায়ী সরকারী কর্মচারী থাকেন। এই স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রকৃত্যক বা আমলা বলে। আধুনিক শাসনব্যবস্থায় এঁদেরই আমলাতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। স্থায়ী, অভিজ্ঞ ও বেতনভুক্ একদল সরকারী কর্মচারীকে নিয়ে আমলাতন্ত্র গঠিত হয়। ফাইনার আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলেছেন: “…a body of officials, permanent paid and skilled.” আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মুখ্যত স্থায়ী সরকারী কর্মচারীরাই সরকারের কার্যাবলী সম্পাদন করেন। গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ এবং সরকারী সিদ্ধান্ত রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেন। গার্নার তাঁর Political Science and Government গ্রন্থে বলেছেন: “Strictly speaking a bureaucratic government is one which is carried on largely by ministerial bureaus and in which important politics are determined. and decisions rendered by the administrative chiefs of such bureaus.” (Political Science গ্রন্থে আমলাতন্ত্রের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত কর্মচারীদের রাষ্ট্রকৃত্যক বলা হয়। এই সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আইন ও বিচার-বিভাগীয় কর্মচারীদের এবং সৈন্যবাহিনীর পার্থক্য আছে। অগ তাঁর English Government and Politics গ্রন্থে রাষ্ট্রকৃত্যকের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে এ হল নর-নারীর এক বিশাল বাহিনী। এই বাহিনী সমগ্র দেশে আইনকে বলবৎ করে এবং দেশবাসীর সঙ্গে জাতীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতানুসারে আমলাতন্ত্র হল ব্যাপক সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে শাসকগণ বা আইন প্রণেতারা (rulers or rule-makers) তাঁদের সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যবস্থা করেন।
আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ওয়েবারের অভিমত:
ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর Essays on Sociology গ্রন্থে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনা মূলত সমাজতান্ত্রিক। তিনি বলেছেন: “(Bureaucracy) is a system of administration characterised by expertness, impartiality and the absence of humanity.” তাঁর মতানুসারে যদি কোন সংস্থা বা সংগঠন আয়তনের বিশাল আকার ধারণ করে, তা হলে সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একদিকে দরকার নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি এবং সঙ্গে সঙ্গে দরকার একদল বিশেষ পরিচালকের। এই সব ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে ক্রমোচ্চ শ্রেণী-কাঠামোর ভিত্তিতে সংগঠিত। তাঁরা নির্ধারিত কাজ দায়িত্বের সঙ্গে এবং সঠিকভাবে সম্পাদন করেন। সরকারী কৃত্যকের সকল পদাধিকারী ব্যক্তি আমলাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। তবে পদমর্যাদা অনুসারে এঁদের ঊর্ধ্বাধঃ শ্রেণীবিন্যাস থাকে। ক্রমকাঠামো অনুসারে তাঁরা অধঃস্তন থেকে ঊর্ধ্বতন নানা স্তরে অবস্থিত। ওয়েবার বলেছেন: “The body of officials activity engaged in public office, along with the respective apparatus or material implements and the files make up a bureau.”
আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অ্যালমণ্ড ও পাওয়েলের অভিমত:
পরস্পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের একটি সংগঠিত প্রশাসনকেই আমলাতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। আমলাতন্ত্র হল প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত এমন একটি সংগঠন যেখানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল-এর মতানুসারে আমলাতন্ত্র বলতে এমন এক ব্যাপক সংগঠনকে বোঝানো হয়ে থাকে যার মাধ্যমে শাসক বা আইন প্রণয়নকারিগণ নিজেদের সিদ্ধান্তকে বলবৎ করার চেষ্টা করেন। এই দুই চিন্তাবিদ তাঁদের Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…when we speak of bureaucracies we are referring to the relatively elaborate organisation through which the rulers or rule-makers seek to implement their decision.” তবে আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসকদের উচ্চস্তরের সঙ্গেই জড়িত। উচ্চপদস্থ বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন বা বিশেষজ্ঞ স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের আমলা বলা হয়—নিম্নস্তরের সরকারী কর্মচারীদের নয়।
আমলাতন্ত্র সম্পর্কে গার্নার ও ফাইনারের অভিমত:
গার্নারের মতানুসারে আমলাতন্ত্র হল এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে সরকারী কাজকর্ম মূলত বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয় এবং দপ্তরের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিগণ সরকারী নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। ফাইনারের মতানুসারে আমলাতন্ত্র বলতে স্থায়ী, অভিজ্ঞ ও বেতনভুক্ত কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। তিনি বলেছেন: “The civil service is a professional body of officials, permanent, paid and skilled.” এই সমস্ত স্থায়ী কর্মচারীরা সরকারী নীতি ও কর্মসূচীকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় কাজে আত্মনিয়োগ করাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন।
Leave a comment