আমলাতন্ত্রের বহুমুখী কার্যাবলী

বর্তমানে সকল রাষ্ট্রেই আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী বহু ও ব্যাপক। সকল দেশের শাসনব্যবস্থাতেই এখন আমলাদের ভূমিকা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। বিশেষত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী বিশেষভাবে বিস্তৃত। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েলের অভিমত অনুসারে আমলাতন্ত্র বলতে বহুমুখী কার্যাবলীর ধারণাকে বোঝায়। বস্তুত আমলাতন্ত্রের এক্তিয়ারকে সুনির্দিষ্টভাবে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কারণ এর কার্যাবলীর পরিধি ক্রমবর্ধমান। আবার আমলাদের কার্যাবলী ও ভূমিকা রাজনীতিক প্রভাবের দ্বারা পরিবর্তিত হয়। বিশেষত আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ বিষয়টিকে বিতর্কিত করে তুলেছে। যাইহোক রাজনীতিক শাসকের দ্বারা প্রণীত নীতি আমলাদের মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়িত হয়। এই আমলাতন্ত্রের সঙ্গে দেশের আইনসভা, বিভিন্ন রাজনীতিক দল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী প্রভৃতির সংযোগ-সম্পর্ক স্থাপিত হতে দেখা যায়। মার্কসবাদী চিন্তাবিদ্রা আধুনিক আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী ও ভূমিকার অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তারের কারণ হিসাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার কাজকর্মের পরিধির প্রসারের কথা বলে থাকেন। বর্তমানে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই আমলাতন্ত্র বহুমুখী কার্যসম্পাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণত আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নিম্নলিখিত কার্যাবলী সম্পাদিত হয়।

(১) শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা: আমলারা দেশের শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন। প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থায় আমলাদের এই ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিককালের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক প্রশাসকগণ দেশের শাসনকার্য পরিচালনার নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে পারেন না। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আজ একটি দল নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শাসন ক্ষমতা দখল করে। পরবর্তী নির্বাচনে অন্য একটি দল ক্ষমতাসীন হতে পারে। তা ছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য কারণেও রাজনীতিক উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটে। এবং সরকারী ক্ষমতায় বিভিন্ন রাজনীতিক দলের আগমন ও নিষ্ক্রমণ ঘটে। সরকারের এই পরিবর্তনশীলতার কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রশাসন হল একটি নিরবচ্ছিন্ন বিষয়। কোন কারণেই তা থেমে থাকতে পারে না। দেশের শাসনকার্যে ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য একদল স্থায়ী সরকারী কর্মচারী একান্তভাবে অপরিহার্য। এই অ-রাজনীতিক শাসকরাই দেশের শাসনব্যবস্থায় নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন। তাঁরা সর্বদা প্রশাসনিক কাঠামোকে অটুট রাখেন। আমলারা দেশের রাজনীতিক উত্থান-পতনের ঊর্ধ্বে থাকেন। তারা নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার ফলে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। সুশাসনের স্বার্থে প্রশাসনের ধারাবাহিকতা অপরিহার্য।

(২) দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা: সরকারী কর্মচারীরা দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করেন। শাসনকার্য পরিচালনার দুটি দিক আছে। একটি হল শাসননীতি নির্ধারণ এবং অন্যটি হল শাসননীতি বলবৎকরণ। শাসননীতি নির্ধারণ করেন রাজনীতিক প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ (political executive)। স্থায়ী সরকারী কর্মচারীরা বা আমলারা সংশ্লিষ্ট নীতিকে বাস্তবে কার্যকর করেন। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে প্রয়োগ করে আমলারা দেশের দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁরা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকেও বাস্তবে বলবৎ করেন। এইভাবে আমলাদের মাধ্যমে সমগ্র দেশে আইনের শাসন কার্যকর হয়। আবার এইভাবেই দেশবাসীর সঙ্গে সরকারের সংযোগ ঘটে। অগ এ প্রসঙ্গে আমলাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন: “They translate law into action from one end of the country to the other and bring the rank and file of the citizenry into daily contact with the government.” এ প্রসঙ্গে অ্যালান বল-এর অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “We have seen that a rigid distinction between rule-making and rule application is difficult and that the policy-making process, even in liberal democracies where the division is possibly easier, has to be defined broadly. This blurring of functions is inevitable given the extent of governmental activity and the permanence and specialised skills of the civil servants.”

(৩) বিশেষীকৃত জ্ঞান সরবরাহ: অভিজ্ঞ আমলারা রাজনীতিক শাসনকর্তাদের বিশেষীকৃত জ্ঞান সরবরাহ করেন। আধুনিক শাসনব্যবস্থা নানা কারণে অত্যন্ত জটিল। এখনকার এই শাসনব্যবস্থা সাধারণ জ্ঞান বুদ্ধির অগম্য। এরজন্য প্রয়োজন বিশেষীকৃত জ্ঞানের। রাজনীতিক শাসক বা মন্ত্রীদের সাধারণত তা থাকে না। কারণ তাঁরা অভিজ্ঞ শাসক হিসাবে নয়, রাজনীতিক নেতা হিসাবে ক্ষমতাসীন হয়ে থাকেন। এই অবস্থায় সরকারী নীতি নির্ধারণ ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলারা তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতার দ্বারা মন্ত্রীদের সাহায্য করেন। অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আমলারাই দেশের শাসনকার্যে বিশেষীকৃত জ্ঞান ও কলাকৌশলকে সংযুক্ত করেন। আবার আইনসভার সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব মন্ত্রীদের দিতে হয়। মন্ত্রীদের এই সমস্ত জবার বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ আমলারাই তৈরি করে দেন।

(৪) আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কাজ: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। আইনসভা আইন প্রণয়ন করে। জনপ্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। মন্ত্রীরাই অধিকাংশ আইনের খসড়া প্রস্তাব বা বিল আইনসভায় উত্থাপন করেন। এই বিল রচনা হল একটি বিশেষজ্ঞের কাজ। এই কাজ কুশলী আমলারাই করে থাকেন। বস্তুত এখনকার জটিল প্রকৃতির আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কলাকৌশলগত জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা রাজনীতিক প্রশাসকদের থাকে না। তাই আমলাদের হাতেই এই দায়িত্ব ছাড়তে হয়। আমলারা আর একভাবে আইন প্রণয়ন কার্যে অংশগ্রহণ করেন। আমলারা ‘অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন’ (delegated legislation) বা ‘প্রশাসনিক দপ্তর প্রণীত আইন’ (departmental legislation) প্রণয়ন করে থাকেন। বর্তমানে জনকল্যাণমূলক ও কর্মমুখর রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বহু আইনের প্রয়োজন হয়। তাই আইনসভা সকল আইন বিস্তারিতভাবে প্রণয়ন করতে পারে না। আইনের মূল কাঠামোটি আইনসভা প্রণয়ন করে দেয় এবং এই মূল কাঠামোর মধ্যে থেকে আইনের খুঁটিনাটি নিয়ম-কানুনগুলি প্রণয়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতা শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত করে। পদস্থ সরকারী কর্মচারীরাই শাসন-বিভাগের এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আইন ব্যাখ্যা, উপ-আইন বা নিয়ম-কানুন প্রণয়ন, আদেশ-নির্দেশ প্রস্তুত প্রভৃতির মাধ্যমে আমলারা আইনের ফাঁক পূরণ করে থাকেন। শাসন-বিভাগের এই সমস্ত আদেশ নির্দেশ শাসন-বিভাগীয় আইন বা অধস্তন আইন হিসাবে বিবেচিত হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বল-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: “The importance of these lawmaking functions has been enhanced with the increased powers of governments to frame rules and regulations with less reference to the legislature than the formal rule-making process requires.” বল আরও বলেছেন: “The definition of a legislative’ sphere in the French Fifth Republic, reserving some areas to the executive, is a more ambitious attempt in the exercise of delegated legislative functions.”

(৫) সংবাদ ও তথ্যাদি সরবরাহ: আমলারা সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সরকারী নীতি ও কার্যাবলী সম্পর্কিত যাবতীয় সংবাদ ও সঠিক তথ্যের উৎস হল আমলাতন্ত্র। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইন-বিভাগ এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগ প্রয়োজনীয় তথ্যাদির ব্যাপারে আমলাদের উপর নির্ভর করে। আবার সরকারী নীতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কিত সংবাদ ও তথ্যাদির ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের, রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীসমূহকে এবং জনগণকেও প্রায় ক্ষেত্রে বিভাগীয় আমলাদের দ্বারস্থ হতে হয়। বর্তমানে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তথা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় জনসংযোগ হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমলাদের এ ভূমিকাও তাৎপর্যপূর্ণ। অ্যালান বল বলেছেন: “Policy implementation at all levels and assisting ministers in their relations with their representative assemblies in such fields briefing ministers for questions and parliamentary committees of investigation and drafting legislation are functions of the civil service.”

(৬) বিচারকার্য সম্পাদন: এখন আমলাদের কিছু বিচার সম্পর্কিত কার্যও সম্পাদন করতে হয়। বর্তমানে শাসন-বিভাগীয় আদালত ও শাসন-বিভাগীয় বিচারের মাধ্যমে বেশ কিছু বিবাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। বিভাগীয় ন্যায়বিচার (administrative justice) বা প্রশাসনিক বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব আমলাদের পালন করতে হয়। শাসন-বিভাগীয় বিচার সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শাসন বিভাগীয় আদালত বা ট্রাইবুন্যাল পরিলক্ষিত হয়। ভারতেও প্রশাসনিক আদালত (administrative tribunals) -এর ব্যবস্থা আছে। উদাহরণ হিসাবে বাড়ী ভাড়া সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসার ব্যাপারে ভাড়া-নিয়ন্ত্রক (Rent Controller), কর সংক্রান্ত আপীলের জন্য ট্রাইবুন্যাল (Tax Appellate Tribunal), শিল্প সম্পর্কিত বিরোধ মীমাংসার উদ্দেশ্যে শিল্প সংক্রান্ত ট্রাইবুন্যাল (Industrial Tribunal) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাধারণত উচ্চপদস্থ আমলারাই এই সমস্ত প্রশাসনিক আদালতে বিচারকার্য সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ফ্রান্সে সরকারী কর্মচারীদের বিরোধের বিচার হয় প্রশাসনিক আদালতে (Droit Administratif)।

(৭) স্বার্থগোষ্ঠীগুলির ব্যাপারে ভূমিকা: উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী (Interest Group) ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Pressure Group) থাকে। উদাহরণ হিসাবে শ্রমিক সংঘ, কৃষক সংঘ, ব্যবসায়ী সংঘ প্রভৃতির কথা বলা যায়। এই গোষ্ঠী যে-কোন উপায়ে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে সরকারী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে গোষ্ঠীগুলি আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমলাদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, -গোষ্ঠীগুলির পরস্পর-বিরোধী দাবি-দাওয়ার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন এবং সরকার ও গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আপস মীমাংসার ব্যবস্থা করেন। এই সমস্ত স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে আমলাগণ প্রশাসনকে উত্তেজনামুক্ত রাখতে চেষ্টা করেন। তার ফলে রাজনীতিক অস্থিরতা দূর হয় এবং রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব বজায় থাকে। এই কারণে এক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “Administrators also take part in process of bargaining, consulting and negotiating with pressure groups.”

(৮) আভ্যন্তরীণ প্রশাসনের ক্ষেত্রে ভূমিকা: আভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনার ব্যাপারেও আমলাদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়। সরকারী নীতি ও কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করার গুরুদায়িত্ব আমলাতন্ত্রের উপর ন্যস্ত থাকে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমলাতান্ত্রিক বিভিন্ন বিভাগ এবং বিভাগীয় কর্মচারীদের সম্পাদিত কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়। তা ছাড়া তৎপরতা, মিতব্যয়িতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনেও দপ্তরসমূহের মধ্যে ঐক্য বা সমন্বয় সাধন দরকার হয়ে পড়ে। আমলারাই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে এবং দপ্তরসমূহের কর্মচারীদের কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিভিন্ন স্তরের আমলাদের আন্তরিক ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারে না। ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা না থাকলে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। তা ছাড়া সরকারের অধস্তন কর্মচারীরা তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে উচ্চপদস্থ আমলাদের ওয়াকিবহাল করেন এবং পদস্থ আমলারাও অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। আবার প্রশাসনের ভারসাম্য ও উৎকর্ষ সংরক্ষণের স্বার্থে আমলাতন্ত্রই কর্মচারীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন প্রণয়ন করে।

(৯) রাজনীতিক কাঠামো সংরক্ষণ: দেশের সংকটকালীন অবস্থায় আমলাতন্ত্র রাজনীতিক কাঠামোর স্থায়িত্ব বজায় রাখে। জাতিদাঙ্গা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য, আর্থনীতিক অব্যবস্থা, দুর্বল দলব্যবস্থা প্রভৃতি নানা কারণে রাজনীতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বিশেষত অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এ আশংকা অধিক। এই সমস্ত দেশে রাজনীতিক স্থায়িত্বের অভাব, রাজনীতিক প্রশাসকদের শৈথিল্য, দলীয় ব্যবস্থায় সংহতির অভাব, শিল্পায়নের অভাব প্রভৃতি কারণে আমলাদের এই ভূমিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এরকম পরিস্থিতিতে আমলাতন্ত্র রাজনীতিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখে। অ্যালান বল-এর অভিমত অনুসারে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উন্নত উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণের স্বার্থে আমলাতন্ত্রের রক্ষণশীল ভূমিকার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বল বলেছেন: “This stabilising function may be linked to the conservative role of bureaucracies in more economically advanced liberal democracies.” প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে ফ্রান্সে পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ফরাসী রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্থিরতা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। এই অবস্থায় ফরাসী আমলাতন্ত্রই দেশের রাজনীতিক স্থায়িত্ব সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছে। বল তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেছেন : “In West Germany the administration inspires greater trust than the politicians, and as in France, bureaucratic continuity has bridged the gaps between the many political upheavals of the twentieth century.” বল আরও বলেছেন: “…and this may sometimes be an even more important function of bureaucracies in developing societies with tribal or ethnic divisions, poverty, lack of industrialisation and weakly structured party system without effective pressure group activity on the wider scale of more developed countries.”

(১০) আধুনিক জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থায় আমলাদের জনসেবামূলক কাজকর্মের গুরুত্বকেও অস্বীকার যায় না। এই সূত্রে আমলারা বিভিন্ন তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনমূলক কাজকর্ম করে থাকেন।

(১১) নীতি প্রণয়ন: নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েলের মতানুসারে কোন সাধারণ নীতি কতদূর পর্যন্ত প্রয়োগ করা হবে তা আমলাদের ব্যাখ্যা এবং তাদের মনোভাব ও নৈপুণ্যের উপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে অধিকাংশ নীতিই হল আমলাদের সিদ্ধান্তের ফল। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাদের এই ভূমিকা সরকারের কাজের পরিধি, আমলাদের নৈপুণ্য ও স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল। কোন কোন ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অজ্ঞতার কারণে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলারা কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন। মন্ত্রীরা তখন আমলাদের মুখপাত্রে পরিণত হন। বর্তমানে আমলাদের ব্যাপক ক্ষমতা না দিলে সুষ্ঠুভাবে প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করা যায় না। জি. এ. ক্যাম্পবেল-এর অভিমত অনুসারে নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ একসঙ্গে চলা উচিত। তাই আমলারা সরকারী নীতি নির্ধারণের প্রত্যেক স্তরের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত থাকেন। অ্যালান বল বলেছেন: “Besides, the degree of policy-making initiative left to top permanent administrators depends on the nature of the political leadership provided by the ministers. Some ministers and heads of departments are more pliable mouth pieces of their civil servants and may lack political support to challenge their own administrators; this is the case when the party system fails to provide a basis of stable government.”

(১২) রাজনীতিক পৃষ্ঠপোষকতা: আমলাতন্ত্র কোন কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সুবিধাদানের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। অনেক সময় রাজনীতিক সমর্থনের ভিত্তিতে আমলাতন্ত্রের উচ্চপদ লাভের সুযোগ পাওয়া যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এই ধরনের পুরস্কার লাভ হল একটি প্রতিষ্ঠিত রীতি। বল বলেছেন: “The bureaucracy is some systems may be an important source of patronage for parties and government leaders: posts in civil service provide rewards for political support.” 

(১৩) অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল-এর অভিমত: অ্যালমও ও পাওয়েল Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে আমলাতন্ত্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলেছেন। 

  • (ক) বর্তমানে বিভাগীয় ন্যায়বিচার ও বিভাগীয় আদালত-এর ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। তার ফলে আমলাতন্ত্রকে কিছু কিছু বিচার বিষয়ক কাজও করতে হয়। 

  • (খ) আমলাতন্ত্র স্বার্থের সমষ্টিকরণ ও গ্রন্থীবদ্ধকরণে উদ্যোগী হয়। 

  • (গ) আমলাতন্ত্র রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংযোগসাধনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। রাজনীতিক দল, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই আমলাদের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করেন। 

  • (ঘ) আমলারা রাজনীতিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকেন। 

  • (ঙ) আমলারাই প্রাক্তন ঔপনিবেশিক অঞ্চল ও সদ্য স্বাধীন দেশে সরকার পরিচালনা, নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন।

(১৪) আভ্যন্তরীণ প্রশাসন: নিজের আভ্যন্তরীণ পরিচালন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আমলাতন্ত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রেও আমলাতন্ত্রের কার্যাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন; বিভিন্ন বিভাগের আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও আন্তঃবিভাগীয় পরিচালনার সংযোগ সম্পাদন; আমলাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা সম্পর্কিত সামর্থ্যের উন্নতি সাধন প্রভৃতি। বল বলেছেন: “A final important function of bureaucracy is that of their own internal management. This includes the improvement of the means of internal communication, administrative coordination within and between departments, and the important field of personnel management training and recruitment.”

ফেনসড-এর মত: ফেনসড বেইলি সম্পাদিত American Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে ‘Development Administration’ নামক রচনায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে উন্নয়নমূলক প্রশাসনের ধারণা ও প্রয়োগ আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার পরিধিকে প্রসারিত করেছে। জনপ্রশাসন ও তুলনামূলক প্রশাসনের সেই অংশই হল উন্নয়নমুখী যার উদ্দেশ্য প্রশাসন ও আর্থনীতিক উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। বস্তুতপক্ষে সাম্প্রতিককালের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা: আমলাতন্ত্রের কার্যাবলী সম্পর্কিত উপরিউক্ত আলোচনা মূলত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়েছে। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের মত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় পরিস্থিতি স্বতন্ত্র প্রকৃতির। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকার গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয় না বটে, কিন্তু সমাজব্যবস্থায় এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। সকল ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সামগ্রিক প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি সমগ্র শাসনব্যবস্থার মধ্যে সংহতি ও স্থিতাবস্থা সংরক্ষণ করে।