বাকাটক বংশ:
উত্তর ভারতে গুপ্তবংশের উত্থানের সমসাময়িককালে দাক্ষিণাত্যের মধ্যাঞ্চলে বাকাটক (বা বকাটক) রাজবংশের উত্থান ঘটেছিল। বাকাটক বংশ সম্পর্কে মূলত লেখমালার উপর নির্ভর করতে হয়। এঁরা কোন মুদ্রা প্রচলন করেন নি। গুপ্তবংশের মতই বাকাটক রাজবংশের প্রাথমিক ইতিহাস কিছুটা রহস্যাবৃত। অনুমিত হয় যে, বিন্ধ্যশক্তি নামক জনৈক ব্যক্তি আনুমানিক ২৫০/৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাকাটক বংশের শাসন সূচনা করেছিলেন। বিন্ধ্যশক্তি নামকরণ থেকে অনুমান করা হয় যে, বিন্ধ্য পর্বতমালার সন্নিহিত ভূখণ্ডে বাকাটকদের শাসন শুরু হয়েছিল। বিন্ধ্যশক্তি প্রায় পঁচিশ বছর শাসন পরিচালনা করেছিলেন। পরবর্তী শাসক প্রবর সেন দীর্ঘ ষাট বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন (২৭৫-৩৩৫ খ্রিঃ)। প্রবরসেনের উদ্যোগে বাকাটক বংশ শক্তিধর হয়ে উঠেছিল। প্রবর সেনের আমলে বাকাটক বংশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব উত্তরে বুন্দেলখন্ড থেকে দক্ষিণে প্রাচীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। ভি. ভি. মিরাশি ও অজয় মিত্র শাস্ত্রীর রচনা থেকে জানা যায় যে, প্রবর সেন তাঁর কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে প্রায় সাতটি ‘সোমযজ্ঞ’ এবং একাধিক ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’ সম্পাদন করেছিলেন। সম্ভবত তিনি ‘সম্রাট’ উপাধিও নিয়েছিলেন। প্রবর সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতমীপুত্র অকালে প্রয়াত হন। তাই সিংহাসনে বসেন অপর পুত্র শর্বসেন। তাঁর আমলে বাকাটক বংশ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। (৩৩৫ খ্রিঃ)। গৌতমীপুত্রের বংশধররা নন্দীবর্ধন নামক স্থানে (বর্তমান নাগপুরের সন্নিকটে) রাজ্য গড়ে তোলেন। অন্যদিকে শর্বসেনের উত্তরাধিকারীগণ ‘বৎসগুল্ম’ নামক স্থানে (বর্তমান মহারাষ্ট্রের আকোলা জেলায়) শাসন কায়েম করেন।
নন্দীবর্ধনে বাকটিক শাখার প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন রুদ্রসেন (৩৩৫-৩৬০ খ্রিঃ)। তিনি সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক ছিলেন এবং সম্ভবত গুপ্তরাজার আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন পৃথিবীসেন। মধ্যপ্রদেশের বাখেলখণ্ডে প্রাপ্ত ব্যাঘ্রদেবের দু’টি লেখতে পৃথিবীসেনকে ঐ অঞ্চলের অধিপতি বলা হয়েছে। অর্থাৎ উত্তরমুখে মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে বাকাটকদের কর্তৃত্ত্ব সম্প্রসারিত হয়েছিল। পরবর্তী শাসক ছিলেন দ্বিতীয় রুদ্রসেন। নাগপুরে তাঁর দু’টি লেখ পাওয়া গেছে।
গুপ্তরাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক উভয় বংশের মিত্রতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। মৃত্যুকালে দ্বিতীয় রুদ্রসেনের তিন পুত্র দিবাকর সেন, দামোদর সেন এবং দ্বিতীয় প্রবর সেন নাবালক ছিলেন। তাই প্রভাবতী গুপ্তা স্বয়ং শাসনকাজ পরিচালনা করতে থাকেন। স্বভাবতই এই পর্বে বাকাটক রাজ্যের প্রশাসনে গুপ্ত রাজাদের প্রভাব অনেকটাই বেড়ে ছিল। অনুমানিক ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন। পরবর্তী শাসক হন দামোদর সেন। তিনি প্রায় পঁচিশ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। পরবর্তী শাসক দ্বিতীয় প্রবর সেনের আমলে (৪৪০-৪৬৫ খ্রিঃ) বাকটিক রাজ্য প্রবল ক্ষমতাশালী ছিল। মধ্যপ্রদেশের ত্রিপুরী অঞ্চলে (জব্বলপুরের নিকট) তাঁর ২৩ তম রাজ্যবর্ষের একটি তাম্রশাসক পাওয়া গেছে। তাই মনে করা হয় যে বাকাটকরা উত্তরমুখী বিস্তার নীতি নিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রবর সেন ‘প্রবরপুর’ নামক নতুন নগর প্রতিষ্ঠা করে আনুমানিক ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে নন্দীবর্ধন থেকে প্রবরপুরে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। কদম্ব বংশের (কুন্তল) সাথেও বাকাটকদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। নন্দীবর্ধন শাখার শেষ দুই শাসক ছিলেন নরেন্দ্র সেন ও তাঁর পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবী সেন। দ্বিতীয় পৃথিবী সেনের আমলে সম্ভবত এই বাকাটকশাখা রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিল এবং পৃথিবী সেন সেই সংকট থেকে রাজ্যকে মুক্ত করেছিলেন। বালাঘাট লিপিতে তাঁকে ‘পরম ভাগবত’ বলা হয়েছে। আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই শাখার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় ছিল।
বাকাটকদের বৎসগুল্ম শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিন্ধ্যশক্তির পৌত্র এবং প্রথম প্রবর সেনের পুত্র শর্ব সেন। তিনি ‘হরি বিজয়’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন দ্বিতীয় বিন্ধ্যশকি (বিন্ধ্য সেন)। তিনি আনুমানিক ৩৬০ থেকে ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। তাঁর অজন্তা লেখর ভিত্তিতে মনে করা হয় কদম্বদের বিরুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তী শাসক দ্বিতীয় প্রবর সেন (একই নামে নন্দীবর্ধন শাখার একজন শাসক ছিলেন) মাত্র একদশক ক্ষমতাসীন ছিলেন (৩৮৫-‘৯৫ খ্রিঃ)। তাঁর মৃত্যুর পর শিশুপুত্র দ্বিতীয় শর্বসেন সিংহাসনে বসেন এবং দীর্ঘ পাঁচ দশক কাল (৩৯৫-৪৪৫ খ্রিঃ) শাসন পরিচালনা করেছিলেন। বৎসগুল্ম বাকাটকবংশের শেষ দুই শাসক ছিলেন যথাক্রমে দেব সেন (৪৪৫-‘৭০ খ্রিঃ) এবং তাঁর পুত্র হরিষেণ (৪৭০-‘৯৫ খ্রিঃ)। হরিযেন এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব করতেন বলে অনুমিত হয়। তাঁর অজন্তা গুহালেখ থেকে জানা যায় যে কুন্তল, অবন্তী (পশ্চিমমালব), কলিঙ্গ (ওড়িয়া), কোশল (ছত্তিশগড়), লাট (গুজরাটের দক্ষিণভাগ), এবং অন্ধ্র পর্যন্ত এলাকা তাঁর শাসনাধীন ছিল।
Leave a comment