পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য:

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য চর্চার ক্ষেত্রে পল্লব রাজাদের কীর্তি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা শ্রীমণ্ডিত। ধারাবাহিকতার বিচারে পল্লব শিল্পের রীতি ও প্রকরণ ছিল স্বতন্ত্র। চোল শিল্পের বিরাটত্ব পল্লব শিল্পে ছিল না। কিন্তু সৌন্দর্য ও সুষমার দিক থেকে তা ছিল দৃষ্টিনন্দন। এ যুগের শিল্পভাবনা ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। পল্লব শিল্পের বৈশিষ্ট্য, হল একটি গোটা পাহাড় কেটে রথ বা মন্দিরের আকৃতি দেওয়া এবং সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের কাজ দ্বারা সেই স্থাপত্যকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা। পল্লব শিল্পীরা সম্ভবত পরম্পরাগত ঐতিহ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। প্রথম পর্বে শিল্পীদের উপকরণ ছিল কাঠ জাতীয় ক্ষয়শীল বস্তু। তাই সেগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে পাহাড়কাটা মন্দিরগুলিকে আকস্মিক বলা যায় না। এগুলিতে গুপ্তযুগের ‘তল বিশিষ্ট’ মন্দিরের অভিযোজন পাওয়া যায়। এই অভিযোজনের সময় পল্লব শিল্পীরা অনিবার্যভাবে কিছু কিছু স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করেছিলেন। প্রথম পর্বে পল্লব শিল্পকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (১) মহেন্দ্র বর্মনের আমলে নির্মিত সাধারণ স্তম্ভযুক্ত মন্ডপ। (২) প্রথম নরসিংহবর্মন ও তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী শাসকদের আমলে নির্মিত একশিলা মন্দির। মহেন্দ্রশৈলীর বৈশিষ্ট্য হল পাহাড় খোদাই করে মন্দির নির্মাণ। এগুলি বৃত্তাকার এবং ঘন ক্ষেত্রকার স্তভযুক্ত। একাম্বরনাথ মন্দিরের স্তম্ভগুলিতে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বের প্রথম দিকে মন্দির ছিল অনাড়ম্বর, সরল। কিন্তু পরবর্তীকালে মন্দিরগুলি কিছুটা বৌদ্ধবিহারের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। যেমন—উদ্ভবল্লীর ‘অনন্ত শায়ন’ মন্দির বা উত্তর আর্কট জেলার ভৈরব কুণ্ডের মন্দির। এই মন্দিরের অলংকরণ ছিল লক্ষ্যণীয়। এখানে নিম্নে ও শীর্ষে সর্বপ্রথম সিংহ যোগ করা হয়।

দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত মন্দিরের নিদর্শন মহাবলীপুরমে পাওয়া যায়। মহামল্ল গোষ্ঠীর রাজাদের আমলে এগুলি নির্মিত হয়েছিল বলে এই রীতিকে মহামল্ল রীতি বলা হয়। এখানে ছিল ১০ টি মণ্ডপ ও ৭ টি রথ। এই রথগুলিকে একত্রে সপ্তপ্যাগোডা বলা হয়। প্রতিটি রথ একটি বৃহদাকার প্রস্তরখণ্ড খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। রথের শিল্পরীতি অনেকটা মণ্ডপের মতোই। তবে এতে দারুশিল্পের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। রথগুলির অভ্যন্তর ভাগ অসম্পূর্ণ। সম্ভবত এগুলি ব্যবহৃত হত না। রথগুলি সম্ভবত শৈব ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ৭ টি রথ ছিল পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী ও গণেশের নামে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম ছিল দ্রৌপদী রথ। এটি ছিল চতুষ্কোণ মন্দির। যার ছাদটি চতুষ্কোণ বক্ররেখা দ্বারা বেষ্টিত। অন্য রথগুলি পিরামিডাকৃতি। তাদের প্রতিটি তল কার্নিশযুক্ত এবং চৈত্যের মত খিলান দ্বারা শোভিত। ভীম ও গণেশের রথের পরিকল্পনা আয়তাকার। দুটির শীর্ষদেশ নলাকৃতি খিলান বিশিষ্ট। অন্যদিকে চতুষ্কোণযুক্ত অর্জুন ও ধর্মরাজ রথের শীর্ষদেশ গম্বুজ আকৃতি স্তুপিকা দ্বারা শোভিত।

স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে নির্মিত মন্দিরগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণির মন্দিরের সংখ্যা ছয়। এগুলি নির্মিত হয়েছিল রাজসিংহ গোষ্ঠীর আমলে। এদের মধ্যে তাঁর মন্দির, ঈশ্বর মন্দির ও মুকুন্দ মন্দির মহাবলী পুরমে অবস্থিত। একটি আছে পনমলইতে এবং শেষ দুটি হল কাঞ্চীর কৈলাস মন্দির ও বৈকুণ্ঠের পেরুমল মন্দির। দ্বিতীর সারির মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর আমলে— এগুলি আয়তনে ছোট ও অনুন্নত।

পেরুমল মন্দিরকে শিল্পভাবনার পরিণত রূপ বলা হয়। এখানে দ্রাবিড় শিল্পীরা অকারণ বাহুল্য বর্জন করেছেন। মহাবলীপুরমের মন্দিরটি প্রাচীনতম। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায় একে তীর মন্দির বলা হয়। এখানে পাশাপাশি দুটি মন্দির অসামঞ্জস্য ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি মন্দিরে পিরামিডের মতো একটি বিমান আছে। S. K. Saraswati বলেছেন ‘এখানে শিল্পীরা এক নতুন আকাঙ্খা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।’ কাঞ্চীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরকে সুষমা মণ্ডিত রূপকল্পনার সার্থক দৃষ্টান্ত বলা যায়। আপাতভাবে বৌদ্ধ স্তূপ মনে হলেও অধ্যাপক Saraswati এগুলিকে দ্রাবিড় শিল্পরীতির নিদর্শন বলে মনে করেন। দ্রাবিড় শিল্পরীতি পরবর্তীকালের চোল রাজাদের যেমন প্রভাবিত করেছিল তেমন ইন্দোনেশিয়া ও ইন্দোচীনে স্থাপিত উপনিবেশগুলি গড়ে ওঠায় স্থাপত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল মুক্তেশ্বর ও মাতঙ্গেশ্বর মন্দির।

দক্ষিণ ভারতে ভাস্কর্য শিল্পের সূচনা ঘটেছিল পল্লব আমলে। ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন মহেন্দ্রবর্মন, তাঁর উদ্যোগে গুহামন্দিরগুলি উৎকীর্ণ হয়েছিল। নরসিংহ বর্মন মহাবলীপুরমের রথমন্দির গুলি ভাস্কর্যমণ্ডিত করেছিলেন। মহামল্লযুগের বরাহ গুহামন্দিরে বরাহ অবতার, গজলক্ষ্মী, দুর্গা প্রমুখের মূর্তি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মহাবলীপুরমের রথমন্দিরগুলি দেবতা ও মানব দেহের ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। এখানে পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণু, প্রথম মহেন্দ্রবর্মন, নরসিংহবর্মন প্রমুখের প্রতিকৃতি দেখা যায়। প্রথম দুই রাজার সাথে রানীদের প্রতিকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এই পর্বের শেষ দিকের কাজে বেঙ্গীর ভাস্কর্যরীতির প্রভাব দেখা যায়। অধ্যাপক Saraswati লিখেছেন, “বেঙ্গীর মূর্তিগুলির ভাবাবেগ পল্লব মূর্তিগুলিতে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বেঙ্গীর তুলনায় পল্লব মূর্তিগুলি অনেক সংযত। তবে এখানে কোন কোন ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যে অনুসৃত গুরুভার দেহের আভাস পাওয়া যায়।

মহাবলীপুরমে ‘গঙ্গাবতরণ’ শীর্ষক প্যানেলটি বিশেষভাবে ছবিটি আকর্ষণ করে। এই ভাস্কর্যের প্রশংসা করে চিত্রসমালোচক গ্লাইসেট বলেছেন, ‘a regular fresco in stone, a masterpiece of classic-art.” ভাস্কর্যটিকে শিল্পরসিকেরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মনে করেন। এখানে কোন, কৃত্রিমতা নেই। মানুষ, দেবতা, অর্ধ-দেবতা, জীব-জন্তু, সন্ন্যাসী প্রভৃতির একটি সম্পূর্ণ জগৎ এই ভাস্কর্যে পরিপূর্ণরূপে উপস্থিত। তাই অনেকে এটিকে প্রস্তর নির্মিত প্রাচীর চিত্র’ বলেছেন। পরিপূর্ণ সংযমবোধ মূর্তিগুলিকে মহিমান্বিত করেছেন। গোটা রিলিফ (relief) টিকে ক্রমানুসারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন মনে হয় বাঁচার আনন্দ ও উচ্ছাসে ভরা মূর্তিগুলি পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম উঠে আসছে। গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব জিজ্ঞাসার পরিবর্তে এই মূর্তিগুলিতে উদার প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ বিধৃত হয়ে আছে। পশুমূর্তিগুলিতেও শিল্পীদের মমত্ববোধ প্রতিফলিত। পল্লব শিল্পীদের গভীর রসবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত হল ‘তপস্বী বিড়াল’ মূর্তিটি।

মহাবলীপুরমের অনুরূপ নিদর্শন গুহামন্দিরের কয়েকটি রিলিফে দেখা যায়। এগুলির মধ্যে কৃষ্ণমণ্ডপে পশু পালকের জীবন সংক্রান্ত দৃশ্যটি স্মরণীয়। ‘মহিষমর্দিনী মণ্ডপে’ যুদ্ধ ও শান্তিঅবলম্বনে দুটি বিপরীতধর্মী প্যানেল আছে। একটিতে দেখা যায় তেজদীপ্তি কর্মপ্রেরণার প্রকাশ ও অন্যটিতে আছে গভীর প্রশান্তি। বরাহ মণ্ডপের রিলিফ দুটিতে অপূর্বভাবে তেজ ও গতিবেগের সাথে ধৈর্য ও প্রশান্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।

শিল্পরসিকেরা মনে করেন বেঙ্গীর ভাস্কর্যকর্মে একধরনের শিথীল অবসাদ গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু পল্লব আমলের মূর্তিগুলি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। বেঙ্গীতে ইন্দ্রিয় পরায়ণতা গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু পল্লব ভাস্কর্যে তার অনুপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। তবে পল্লবযুগে নারীমূর্তিগুলিতে পুরুষ নির্ভরতার দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে। সমকালীন ইলোরার মূর্তিতে আলোছায়ার যে খেলা দেখা যায় পল্লব ভাস্কর্যে তা অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে পল্লব মূর্তিগুলি অনেক বেশী স্পষ্ট ও জীবন্ত।

পল্লব শাসকদের শিল্পভাবনা ও শিল্পানুরাগের সাথে স্থানীয় শিল্পীদের শিল্পচেতনার সমন্বয়ের ফলেই পল্লবযুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নবযুগের প্রকাশ ঘটেছিল। দ্রাবিড় শিল্পরীতি যথেষ্ট পরিশীলিত রূপে দেখা যায় পল্লব শিল্পীদের কাজে। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও সীমিত অর্থে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকলা ও বৃহত্তর অর্থে ভারতের শিল্পজগৎ পল্লবযুগের শিল্পকর্ম দ্বারা পরিপুষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল।