বৈষ্ণব পদাবলীর প্রকৃত সমাপ্তি বিরহের মধ্য দিয়ে শাক্তপদাবলীর ‘আগমনী বিজয়া’ পর্যায়ে যে কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে তারও সমাপ্তি বিরহের মধ্য দিয়ে। বৈষ্ণব পদাবলীতে এই বিরহ/প্রবাস বা মাথুরের তিনটি রূপ– ভূত, ভবন ও ভাবী। শাক্তপদাবলীতে ভবন বিরহ ও ভাবী বিরহের রূপ বর্তমান। এতে ভূত-বিরহ নেই, কিন্তু চণ্ডীদাসের পদে শ্রীমতী রাধিকার চিত্রাঙ্কনে যেমন মিলনেও বিরহের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে, অনুরূপ আর্তি লক্ষ্য করা যায় আগমনীর পূর্বেই মেনকা চরিত্রে।
এই বিরহের চিত্রায়নে বিশেষত ভাবী বিরহের চিত্রে বৈষ্ণবপদে এবং শাক্তপদে আর একটি সাদৃশ্য বর্তমান, -সাদৃশ্যটি কাকতালীয়বৎ, কোনক্রমেই অবশ্য শাক্তপদে একে বৈষ্ণবপদের প্রভাবজাত বলা চলে না।
অক্রুর বৃন্দাবনে এসেছেন কৃষ্ণকে মথুরায় নিয়ে যেতে রাত্রি প্রভাতেই তিনি যাত্রা করবেন। ভাবী বিরহের আশঙ্কায় শ্রীমতী রাধিকার সকাতর প্রার্থনা—
‘যোগিনী চরণ শরণ করি সাধহ
বান্ধহ যামিনি নাথে।
নখতর চান্দ বেকত বহু অম্বরে।
যৈছে নহত পরভাতে।।’
অর্থাৎ যোগিনী-চরণে শরণ নিয়ে তাকে অনুরোধ কর, যাতে তিনি যামিনীনাথ চন্দ্রকে বেঁধে রাখেন, এবং নক্ষত্র ও চন্দ্র যেন অম্বরে ব্যক্ত থাকে যাতে প্রভাত না হয়।
বৈষ্ণবপদে ভাবী-বিরহের শ্রেষ্ঠ পদ রচিত হয়েছে অর্জুরের আগমনকে উপলক্ষ্য ক’রে। শাক্তপদে অর্জুরের ভূমিকা গ্রহণ করেছ নবমী তিথি— নবমী প্রভাতেই মেনকা ভাবী বিরহের আশঙ্কায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছেন তার করুণ ক্রন্দন—
‘ওরে নবমী নিশি, না হইও রে অবসান।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান।।’
আগমনী-বিজয়ার কাহিনীটি এরূপ—
গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার একমাত্র কন্যা মহাদেবের সঙ্গে বিবাহিতা—কৈলাসে তাদের বাস। বৎসরাত্তে একবার তিনদিনের জন্য উমাকে পিতৃগৃহে নিয়ে আসেন পিতা হিমালয়, কখন-বা উমা নিজেই আসেন। এই তিনটি দিন– শরৎকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী। দুর্গা এবং উমা অভিন্ন। দর্শনীতে বিজয়া অর্থাৎ ঊমা তথা ভগবতীর কৈলাসযাত্রা— স্বয়ং মহাদেব এসে তাঁকে নিয়ে যান। নবমী দিনই মায়ের মন ভাবী বিরহের আশঙ্কায় দীর্ণ হয়ে গেলেও এই আশঙ্কায় সুত্রপাত ঘটে উমার আগমনের মিলন মুহূর্তেই। তাই মেনকা বলেন—
‘গিরি, আমার গৌরী এসেছে
রূপে ভবন আলো হয়েছে…
ভোলানাথ আসবে নিতে দশমীতে
এখনি ভাবিতেছি তাই মনে।
(আমার) আঁধার ঘরের উজল মানিক
ছেড়ে দিব কোন্ পরাণে।’
আসন্ন বিচ্ছেদ-ব্যথায় জননী-হৃদয়ের এই আকুলতা কী মর্মান্তিক হ’তে পারে, তার মাত্র আংশিক পরিচয় পাওয়া যায়– মহাকবি কালিদাস রচিত শকুন্তলার পতিগৃহ যাত্রায় শকুন্তলার পালকপিতা কয় বলেছিলেন,— ‘পীড়াস্তে কথং নু গৃহিণঃ তনয়াবিশ্লেষ-দুঃখৈৰ্ণবে।’—বনবাসী কথের হৃদয়ে যে শোক জেগেছিল, গৃহীদের শোক তার তুলনায় অনেক বেশি—কিন্তু জননী শোকের কোনো তুলনা হয় না।
অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী নবমীতে মাতৃহৃদয়-বেদনার স্বরূপ সম্বন্ধে লিখেছেন— “নবমীর দিন হইতে এই বেদনার রঙ আরও গাঢ় হইয়া উঠিতে লাগিল। কাল আসিয়াই আজ উমা যাইতে চাহিতেছে, মা হইয়া তিনি কোন প্রাণে তাহাকে বিদায় দিবেন? কাল সকালে মহাদেব আসিয়া উমাকে লইয়া যাইবেন, স্মরণ করিতেই মায়ের মন স্রস্ত হইয়া উঠিতেছে, কখনও অবুঝ বালিকার মত বলিতেছেন, ‘কালকে ভোলা এলে বলবো–উমা আমার নাইকো ঘরে।”
“দেখিতে দেখিতে নবমী-নিশীথ আসিয়া পড়িল, এই রজনী প্রভাতে বিদায় লগ্ন, হিমালয় অন্ধকার করিয়া উমা অন্তর্ধান করিবে। তাই এই রজনীকে বিলম্বিত করিবার জন্য মায়ের সে কি আকুল মিনতি, সকরুণ প্রার্থনা। এখনও গৃহে স্বর্ণ-দ্বীপের আলো, কিন্তু রাত্রিপ্রচাতেই সে সব অন্ধকার হইয়া যাইবে। তাই রাত্রির ওপর প্রাণসত্তা আরোপ করিয়া মায়ের কাকুতি। এই সমাসোক্তির ভিতর জননী-হাদয়ের বেদনা রণিয়া উঠিতেছে….এই রজনীকে উপলক্ষ্য করিয়া মাতৃহাদয়ের ‘অস্তগূঢ় বাষ্পাকূল বিচ্ছেদ ক্রন্দন’ অনগলিত হইয়া জন-মনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করিয়াছে। ভাবী বিরহের সকরুণ আর্তনাদে নবমী রজনীর স্বর্ণদীপাবলী ম্লান হইয়া গিয়াছে, ইহার বাতাস মন্থর হইয়া উঠিয়াছে। মায়ের সকল আকাঙ্ক্ষা একস্থানে কেন্দ্রীভূত হইয়া কেবল প্রার্থনা করিয়াছে,—
“যেয়ো না রজনি আজি লয়ে তারা দলে
গেলে তুমি দয়াময়ি এ পরাণ যাবে।
উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে।”
শাক্তকবিদের সর্বাধিক আকর্ষণ নবমীর প্রতি সাধারণ হিসেবে আগমনীতে আনন্দ আর বিজয়ার সঙ্গে বিবাদ বা বিরহের সম্পর্ক থাকলেও মা মেনকার বেদনাদীর্ণ চিত্তের চরম অবস্থা দেখা দিয়েছে নবমীতে শোকের অতিঘাতে মায়ের বোধ-বুদ্ধিও যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাই নবমীনিশি মায়ের চেতনায় সজীব মূর্তিতে বিরাজমান। তাই শাক্তকবিদের প্রায় সকলেই এমন কি যিনি একটিমাত্র শাক্তপদ রচনা করেছেন (যেমন, মধুসূদন দত্ত এবং তার পূর্বোদ্ধৃত পদের নিদর্শন) তিনিও নবমীনিশিকেই উপজীব্য করেছেন।
অত্যস্ত স্বল্প মেয়াদে উমা এলেন মেনকার কাছে এটা ভালো লাগছে না। তাই তিনি প্রতিবেশীদের সাক্ষী রেখে বলেছেন—
‘কাল এসে, আজ উমা আমার যেতে চায়।
ছ’মাস ন’মাস নয়, এসে দশ দিন তো থাকতে হয়-
মাগো, সে দশেতে দশমী হলে কি হবে আমার দশায়।’
নবমীর বিরহ ছিল ভাবী বিরহ, দশমীর বিরহ ভবন বিরহ, দশমী প্রভাত মায়ের নিকট আরও মর্মদাহী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই প্রচণ্ড আঘাতই আবার জননীকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিয়েছে। ‘যেতে নাহি দিব’ বললেও যে যেতে দিতে হয়’-এ পার্থিব সত্যকে তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই মা মেনকা এই সহজ সত্যকে মেনে নিয়ে কামনা করলেন— ‘পুনরাগমনায় চ।’
‘এস মা এস মা উমা, বলো না আর যাই যাই’।
মায়ের কছে হৈমবতি ও কথা মা বোলতে নাই।।
বৎসরাস্তে আসিস্ আবার ভুলিস্ না মা ও মা আমার।
চন্দ্রাননে যেন আবার মধুর ‘মা’ বোল শুনতে পাই।।।’
বৈষ্ণব পদাবলীর অক্রুরের সঙ্গে নবমীর পার্থক্য এই অক্রুর যে কৃষ্ণকে নিয়ে আসেননি। পক্ষান্তরে নবমী নিশিতে বিদায়ের সুর বাজলেও বৎসরান্তে উমাকে আবার ফিরিয়ে আনবার প্রতিশ্রুতি রেখে যায়।
Leave a comment