প্রশ্নঃ “পার্টি-রাজনীতি ও জাতীয়বাদী আন্দোলনের বিচারে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সফল হলেও গণআন্দোলনের মধ্যে বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষের যে আকাক্ষা আর সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল, তা সফল হতে পারেনি।”- উক্তিটি ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের আলােকে বিচার কর।

অথবা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে শ্রেণি রাজনীতির প্রতিই লেখকের যে পক্ষপাত লক্ষ করা যায় তা আলােচনা কর।

অথবা, “গণআন্দোলনে জেগে ওঠা সম্ভাবনার নিরিখে নতুন পার্টি-রাজনীতির তত্ত্বায়নচেষ্টা ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।”- এ সম্পর্কে তােমার মতামত দাও।

উত্তরঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের [১৯৪৩-১৯৯৭] ‘চিলেকোঠার সেপাই’ [১৯৮৬] উপন্যাসের বিষয় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক সুপরিচিত অধ্যায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাথে কার্যকারণ সম্পর্কে যুক্ত এই অভ্যুত্থানের ঘটনাক্রম ও জাতীয়তাবাদী তাৎপর্য লেখক এ উপন্যাসে বিশ্বস্ত ভঙ্গিতেই তুলে এনেছেন। তাতে প্রভাবশালী পার্টিগুলাের কার্যক্রম যেমন উঠে এসেছে, তেমনি শহর-গ্রামের আলাদা বাস্তবতাও চিহ্নিত হয়েছে। ইলিয়াস তার বিশিষ্ট ভাষাভঙ্গি, অতুলনীয় ডিটেইল আর জীবনদৃষ্টির স্বাতন্ত্রে বহুস্তর ইতিহাসকে অনায়াসেই আঁটিয়ে নিয়েছেন উপন্যাসের আদলে। ইতিহাসকে উপন্যাসে রূপান্তরের সময় স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে লেখকের মূল্যায়ন ও পক্ষপাত। উপন্যাসসুলভ নিরাসক্তি অক্ষুন্ন রেখেই লেখক দেখিয়েছেন, পার্টি-রাজনীতি ও জাতীয়বাদী, আন্দোলনের দিক থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সফল হলেও গণআন্দোলনের মধ্যে বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল, তা সফল হতে পারেনি। ক্ষমতালিপ্সু আপসকামী পার্টি-রাজনীতিই এর প্রধান কারুণ। অন্য কারণ মধ্যবিত্তের অপ্রস্তুতি। এ উপন্যাসে গণআন্দোলনের যে সংজ্ঞায়ন ঘটেছে, আন্দোলনের সূচনা ও সমাপ্তিতে পার্টি-রাজনীতির ভূমিকা আর উত্তুঙ্গ মুহূর্তগুলােতে আম-জনতার সক্রিয়তা যেভাবে চিহ্নিত হয়েছে, তা এক ‘বেহাত বিপ্লবে’র কথাই বলে। 

স্পষ্টতই শ্রেণি রাজনীতির প্রতিই লেখকের পক্ষপাত। কিন্তু এই পক্ষপাত শ্রেণি-রাজনীতির বিপ্লবী তত্ত্বের ভিতে দাঁড়ায়নি। বরং বিদ্যমান ব্যবস্থার বহুমাত্রিক অন্যায্যতাই উৎপাদন ও বণ্টনে বুর্জোয়া-বিধির স্বচ্ছতা আর যুক্তির অনুপস্থিতি- তার সিদ্ধান্তের ভিত্তি। বিদ্যমান জাতীয়তাবাদী পার্টি-রাজনীতি কর্মসূচির সীমাবদ্ধতার কারণেই এই অন্যায্যতার প্রতিকার করতে পারবে না। যাদের সেই কর্মসূচি আছে, তারা কি পারবে? ইলিয়াস এ প্রশ্নে কোনাে সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি। কিন্তু গণ মানুষের মুক্তির রাজনীতির কিছু তত্ত্বীয়-প্রায়ােগিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে, যেখানে দেখা। যায়, শ্রেণি-রাজনীতি কেবল জ্ঞানগত ফায়সালার ব্যাপার নয়, বরং গভীরভারে সাংস্কৃতিক ও জীবনযাপন পদ্ধতির ব্যাপার। গণআন্দোলনে জেগে ওঠা সম্ভাবনার নিরিখে নতুন পার্টি-রাজনীতির তত্ত্বায়নচেষ্টা এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

বাস্তবের সােজাসাপ্টা বর্ণনায় ইলিয়াসের যে অনায়াস দখল তার স্মরণীয় পরিচয় আছে ২৩ নম্বর পরিচ্ছেদে। শহিদ আসাদুজ্জামানের শােকসভা ডেকেছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসের লােকজন বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। সেক্রেটারিয়েট থেকে লােকজন দল বেঁধে বেরিয়ে এলে আর অফিসার-গােছের কেউ কেউ মিছিলে যােগ দিলে বুঝা যায় আন্দোলন নতুন মাত্রা পাচ্ছে, অবশ্য বাঁধভাঙা মানুষের জোয়ার এসবের অপেক্ষা না করেই ‘এত জনাকীর্ণ রাস্তাঘাট, এতাে মিছিল, এই রাগী শহর’ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তােপখানা রােড, সচিবালয়ের গেট, আবদুল গণি রােডসহ গলি-উপগলিতে। আগুন লেগে যায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায়, আইয়ুব খানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আস্তানায়। ওসমান দেখে, দেখার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে কিছু মন্তব্য-মূল্যায়নও করে আপন মনে। তাতেই পাঠকের জন্য তৈরি হতে থাকে এক নিখুঁত সাংবাদিক বয়ান। ব্যক্তির চোখ দিয়ে কিন্তু ব্যক্তিকে মুখ্য না করে তৈরি হওয়া সে বয়ান নিরাসক্ত। পক্ষপাতহীনতা অক্ষুন্ন রেখে এক ধরনের দালিলিক মর্যাদা অর্জন করে। ইলিয়াসের এই বর্ণনা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক বয়ানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাস-প্রণেতা মােহাম্মদ হাননান এ দিনের বিবরণে লিখেছেন-

“আসাদ নিহত হওয়ার খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর সঙ্গে সঙ্গে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়… অশ্রুভারাক্রান্ত অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে এক শােকসভায় মিলিত হয়।…. শােকমিছিলের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই মাইল। …. ২১ জানুয়ারি …… পল্টন ময়দানে জনসভারও আয়ােজন করা হয়েছিল। সেই জনসভায় ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ আসাদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বিরাট-দীর্ঘ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিলে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।”

কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা এই আন্দোলনকে বিশেষভাবে বেগবান করেছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে আসাদুজ্জামান ছাড়া অন্তত আরাে দুটি মৃত্যুর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য- ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু আর ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঐতিহাসিক কালক্ৰম অক্ষুন্ন রেখেই ব্যবহৃত হয়েছে। যারা নিজ নামে গুরুত্বপূর্ণ আর যেসব মৃত্যু আন্দোলনের দৃশ্যমান গতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তাদের বর্ণনা নৈর্ব্যক্তিকভাবেই দেওয়া হয়েছে। ইলিয়াস বাড়তি মনোেযােগ দিয়েছেন তাদের প্রতি যারা নামত ইতিহাসে উল্লিখিত হননি, কিন্তু প্রবল সক্রিয়তায় আন্দোলনের সাফল্য নিশ্চিত করেছেন। হাড্ডি খিজির তাদেরই প্রতিনিধি।

মৃত্যু গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ- মৃতের আত্মত্যাগের বিচারেও, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির নিয়ন্ত্রক হিসাবেও। ইলিয়াস মৃত্যুকে মহিমান্বিত করেছেন, নিহত ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর বরাদ্দ করেছেন। প্রায়শই এ পরিসরের একাংশ ব্যয়িত হয়েছে আন্দোলনের সামগ্রিক বয়ানের অংশ হিসাবে, অন্য অংশে ঠাঁই পেয়েছে মৃতের ব্যক্তিগত পরিসর- পারিবারিক-সামাজিক প্রতিক্রিয়া। যেমন- রঞ্জুর ভাই তালেবের ক্ষেত্রে পারভেজের কাঁচা-বাংলায় পাওয়া যায় নিম্নোক্ত বর্ণনা। ‘রাত্রে আমার ভাই বললাে কে নীলক্ষেতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, আমার সিস্টারের হাজবেন্ড এসে বলল, হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনের এক এমপ্লয়ির তাে ডেথ হয়ে গেল। আমি ইমাজিন করতে পারলাম না কে আমাদের তালেব-‘। এই বর্ণনা সামগ্রিক আন্দোলনের নির্বিশেষে পরিচয়। তালেবের ব্যক্তিগত পরিসরে বিশেষত পরিবারে তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া নিপুণভাবে দেখানাে হয়েছে প্রায় পুরাে উপন্যাস জুড়ে।

ঐতিহাসিক বাস্তবকে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনে বদলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইলিয়াস কয়েকটি কার্যকর কৌশলের আশ্রয় নেন। পুরােনাে ঢাকার গলি-উপগলি সমম্বিত ভূগােলের সাথে বিবরণগত আর রণকৌশলগত সমঝােতা রক্ষা করে গড়ে উঠেছে সে বয়ান। এ কথা এমনকি ‘ঘন ঘাস রঙের হেলমেটের সঙ্গে ফিট করা পাঞ্জাবি, বালুচ ও বাঙালি সৈন্যদের’ খােলা। জিপটির ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। গাড়িটি দাঁড়ায় ঠিক সেখানে যেখান থেকে কয়েকটি গলি ঠিকমতাে কাভার করা যায়। আর পায়ে দলে পথ চলা মানুষের থুথুতে সয়লাব রাস্তায় ক্রিকেট খেলুড়ে ‘ছােটো ছেলেরা’ আর তাদের অনুচর নামহীন গােত্রহীন ‘বেওয়ারিশ পিচ্চি’রা খেলতে খেলতেই বা ইতস্তত মিছিল করতে করতেই নিপুণভাবে পিকেটিংয়ের কাজটি সারে- কখনাে সাইকেল বা রিকশার হাওয়া ছেড়ে দিয়ে, কখনাে-বা দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করে। এরকম এক খবর নিয়ে আসে। পিচ্চিদের একটা দল- ‘লম্বু সালামের জিলাপির দুকান আছে না, অর বগলে সাইকেলের পাটসের দুকান আছে না, আছে না, ঐ বন্টু হালায় দুকান খুলছে।’

একাদশ পরিচ্ছেদে লেখক আন্দোলনকে আরাে স্পষ্ট করে আনেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের সমাবেশে সর্বদলীয় মিটিং। তাই আন্দোলনে শরিক নানা পক্ষকে অন্তত জাতীয়তাবাদী আর বামপন্থি অংশকে মােটামুটি স্পষ্ট করে চেনা যায়। এখানেও ইলিয়াস স্থানটাকে চোখের সামনে ছবি আকারে ধরিয়ে দেন। বামপন্থিরা স্লোগান দিচ্ছে দক্ষিণ দিকের গেটের পামগাছের নিচে’র জটলা থেকে; আর জাতীয়তাবাদীরা বেদীর নিচের জটলা থেকে। এসব ফারাক অবশ্য একাকার হয়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যেই জালিম সরকারের দুঃশাসন আর পাকিস্তানি শােষণের বর্ণনায় স্লোগানে। নামহীনভাবে আস্ত মিটিংটাকে এভাবে চিনিয়ে দেওয়ার পর লেখক চেনা এলাকায় প্রবেশ করেন। সেখানে আলাউদ্দিন মিয়া, আনােয়ার, ওসমান, আলতাফ, খিজির, মকবুল হােসেন মােটামুটি প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করে যায়।

ইলিয়াস যে চরিত্রগুলাের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন, ঘটনাপ্রবাহের যে অংশগুলােকে বিস্তারিত পরিসর দিয়েছেন, যেভাবে এ আন্দোলনের সম্ভাবনা আর সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছেন, তাতে দেখা যায়, গণমানুষের বিপুল অংশগ্রহণে যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, মধ্যবিত্তের সংগঠনরূপে প্রভাবশালী পার্টিগুলাে তার সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে। মাত্র- সম্ভাবনাকে ফলবান হতে দেয়নি। গণআন্দোলনের যে অংশটা লেখকের অনুমােদন পেয়েছে, নাগরিক পরিসরেঃ তার যথার্থ প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে খিজির। খিজির একেবারে শুরু থেকেই ‘চার্জড’। সক্রিয় এবং উত্তেজিত। তালেবের মৃত্যুর সময়ে তাকে প্রথম দেখা যায় লােবান জ্বালাচ্ছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে দেখা যায়, ‘খিজির বহুত চার্জড হয়ে ইটা মারছে’। খিজির তার ব্যক্তিগত ইতিহাসসহ লম্বা জায়গা জুড়ে মূর্তি পেয়েছে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে পরের কয়েক পরিচ্ছেদ জুড়ে। অবশ্য তার ব্যক্তিগত ইতিহাস সামষ্টিক ইতিহাসের সমান্তরালে বা অধীনে বর্ণিত। রহমতউল্লাহহ মহাজন আর তার ভাগনে আলাউদ্দিন মিয়ার বগল ঘেঁষে, তাদের আয়-উপার্জন আর শারীরিক-মানসিক প্রবৃত্তিগত সক্রিয়তার সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে খিজির বিশিষ্ট হয়ে ওঠার পরিসর পায়। লেখক তাকে বেশ খানিকটা পরিসর ছেড়ে দেন তাতে আলবত পক্ষপাত আছে; কিন্তু এক ফোঁটা আবেগ নেই। আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক কাঠামাের মধ্যে তার অবস্থান একবিন্দুও মহিমান্বিত হয় না। দশম পরিচ্ছেদেই পরিষ্কার বুঝা যায়, মহাজনের প্রতি পুষে রাখা ঘৃণা আর ক্ষোভই খিজিরের মূল প্রেরণা। সমবেত জনতাকে মহাজনের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার সমস্ত চেষ্টাই সে চালিয়ে যায়। আলাউদ্দিন মিয়ার ধমক খেয়েও মহাজন যে রঙুর বাপকে হুমকি দিয়েছে, নানাভাবে নাজেহাল করেছে, এমনকি আলাউদ্দিন মিয়া না ঠেকালে ‘মনে লয় দুইচাইরখান চটকানা ভি মাইরা দিত’, এ সংবাদ খিজিরের পুনরাবৃত্তিতেই সবার কানে যায়। মিছিলে মহাজনের বিরুদ্ধে ধুয়া ধরে ওই খিজিরই।

খিজির-ওসমানের একটা তাৎপর্যপূর্ণ দ্বৈরথ তৈরি হয় ২৩ নম্বর পরিচ্ছেদের শহিদ আসাদ দিবসের সমাগমে। ওসমান পুরাে সময়টাতে মিছিলের সাথেই ছিল। বারবার সে সক্রিয় হতে চেয়েছে। কিন্তু কিছু করে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যার পর নবাবপুর রােডের ইলেকট্রিসিটিহীন অন্ধকারে প্রজ্বলিত আগুনের শিখার মধ্যে ওসমান খিজিরের ‘ভাঙাচোরা’ গাল দেখতে পায়। তার এক হাতে প্লয়ার, অন্য হাতটি যথারীতি ওপরে তুলে ধরা। এখান থেকে তার ভাঙা গালের উঁচু হাড়গুলাে আগুনের আভায় লাল দেখাচ্ছে, তাকে হঠাৎ খুব বিশিষ্ট বলে মনে হয়। ওসমানের এমন মনে হওয়ার কারণ আসলে খিজিরের সক্রিয়তা ‘মনে হয়, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে-ই’। একটু পরে কারফু ঘােষিত হলে ওসমান খিজিরকে দ্রুত যেতে তাগাদা দেয়; খিজির আপত্তি করে না। লেখকের মূল্যায়নঃ খিজির ভয় পেয়েছে ভেবে ওসমান স্বস্তি পায়, ওসমানের পদক্ষেপ তাই বেশ দৃপ্ত। কিন্তু এই প্রতি তুলনায় ওসমানের জয়ী হওয়ার কোনাে সম্ভাবনাই থাকে না শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিগতভাবে দুজন আলাদা।

‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ে মার্কসবাদী ইলিয়াসের ইতিহাসবােধ বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের একটা স্বাভাবিক কিন্তু স্বল্প-উচ্চারিত সত্য সামনে নিয়ে আছে চেতনাগত ফারাক যেমনই হােক, শ্রেণিচরিত্রে পুরােনাে আর নতুন জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ফারাক নাই; উৎপাদন সম্পর্কে আধিপত্য হাসিল করা, শােষণকে বৈধ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার আর শ্রেণি ঘৃণায় তারা রসুনের গােড়ার মতাে এক। নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনিবার্যতা তিনি মানেন; একে হয়তাে ইতিহাসের দিক থেকে ‘অগ্রগতি’ও মনে করেন; কিন্তু সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তর যার বাসনা, তার কাছে এ ‘অগ্রগতি’ ন্যূনতম মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

আসলে পার্টি রাজনীতি আর বিপ্লবী রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ছকের বাইরে গণআন্দোলনের বিশেষ সংজ্ঞায়ন এবং তত্ত্বায়নই ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসকে আরােপিত তত্ত্বের গােলামি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিপ্লবী রূপান্তরের সম্ভাবনা দেখানাে হয়েছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। কিন্তু সে সম্ভাবনার অসফল পরিণতির কারণগুলােও ওই বাস্তবতার মধ্যেই ছিল। খিজির বা চেংটুর মতাে বিপ্লবীরা নিজ নিজ বাস্তবতার সীমার মধ্যেই ভূমিকা পালন করে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়। তাদের সক্রিয়তার ধরন আর ব্যর্থতা সম্ভাব্য নতুন রাজনীতির বার্তা ঘােষণা করে। স্পষ্টতই ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে গণআন্দোলন পার্টি রাজনীতির চেয়ে অনেক ব্যাপক-গভীর ধারণা, যার সফল পরিণতির জন্য যথার্থ কর্মসূচিসহ জনগণের পার্টি আবশ্যক। ৩৩ নম্বর পরিচ্ছেদে পল্টনের সমাবেশের পর হােটেলে আন্দোলনকারীদের নানা পক্ষ তর্কে লিপ্ত হয়।

গণআন্দোলনের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পরিচয় আছে উপন্যাসের শেষাংশে। লেখক জাতীয়তাবাদী গালগল্প নিয়ে বিস্তর ঠাট্টা করেছেন। পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে বাঙালির এই লড়াইয়ে শােষণের ফিরিস্তি আর বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের বয়ান পরিপূর্ণ সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত অন্যায্য বাঙালি সমাজে ন্যায়-প্রতিষ্ঠার কথাটা জাতীয়তাবাদীরা তােলেনি আন্দোলনের সময়ে তাে নয়ই, আগে-পরেও নয়। লেখক বামপন্থিদের মুখে এই অবস্থানের সমালােচনা পুরাে উপন্যাস জুড়েই জারি রেখেছেন। শেখ সাহেব মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ঠাট্টার পরিমাণ যেন আরেকটু বাড়িয়ে দেন। শেখ সাহেব রিলিজড হয়ে রেসকোর্সে ভাষণ দেন। পরে পুলিশের হামলা ঠেকাতে গিয়ে জনতার একাংশ ঢুকে পড়ে ঢাকা ক্লাবে। উত্তেজিত জনতা ক্লাব আক্রমণ করে। ক্লাবের একজন বেরিয়ে প্রশ্ন করেঃ ‘আমরা কি বাঙালি নই’ মহল্লায় ফিরে ওসমান দেখে আলাউদ্দিন মিয়া বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের ওপর রাগ ঝাড়ছে-দশ ঘন্টা কারেন্ট নাই। কারা কষ্ট পাচ্ছে? বাঙালিরাই তাে!’

বৈরাগীর ভিটার: বটগাছ-কাহিনিকে বলা যায় গণআন্দোলন সম্পর্কিত মূল্যায়নের প্রতীকী প্রকাশ। চেংটু আর জালাল মাস্টারের বয়ানে বটগাছের বেধ জমকালাে ফিরিস্তি তৈরি হয়। তাতে এই বটপল্লিতে অশরীরী জীবের যেমন সংস্থান হয়, তেমনি গ্রামবাসীর ভালােমন্দের সাথেও গাছটি জড়িয়ে পড়ে। জালাল মাস্টারের বয়ানে এই বটগাছের সাথে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের একটা জুতসই সম্পর্কও তৈরি হয়। ৩৯ নম্বর পরিচ্ছেদে আছে বটপ্রাঙ্গণের জঞ্জাল-সাফের প্রসঙ্গ কাটছে তারাই যারা এ অলৌকিকতার বড়াে ভােক্তা। দরকারে কাটছে। গণ আদালত বসবে। প্রচুর লােক। জায়গা দরকার। কাটে প্রধানত দূরের লােকজন, যারা এ গাছ সম্পর্কে তেমন জানে না। আর চেংটু। চেংটুর মধ্যে বিপ্লবীর বৈশিষ্ট্য এখানেও অক্ষুন্ন থাকে। বটগাছ কাটার বর্ণনা লেখক যেভাবে দিয়েছেন, তাতে বুঝা যায়, দীর্ঘদিনের জঞ্জাল দূর হওয়ার একটা প্রতীক হিসাবে একে তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এই বটগাছতলায় পরে মিটিং করে জাতীয়তাবাদীরা। আনােয়ারের বড় মামা। বিরােধী দলের রাজনীতিকা জেল-খাটা বড়মামা। সাথে আফসার গাজী। ঢাকা থেকে লোক আসে। কলেজের ছাত্ররা আসে। খয়বার গাজীসহ সবার সাথে মিলেমিশে থেকে পশ্চিমা শক্রদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে বক্তৃতা করে। আন্দোলনকারীদের সাফ করা ময়দান দখল করে তারা গ্রামে স্থিতাবস্থা তৈরি করে। স্থিতাবস্থার মধ্যেই খুন হয়ে যায় চেটু। চেংটুকে হত্যা করার পর ভদ্রলােকেরা প্রচার করে যে বটগাছ কাটার কারণে তাকে জিন মেরে ফেলেছে। এ ব্যাপারে জালাল মাস্টারেরও কোনাে সন্দেহ থাকে না।

‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের বটগাছ-কাহিনি এক বিশদ প্রতীকে ‘বেহাত বিপ্লবে’র কথাই বলে। চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের কাহিনিতে গ্রাম আর শহরের যথার্থ মেলবন্ধন ঘটেনি। নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে একে উপন্যাসটির সীমাবদ্ধতাই বলতে হবে। কিন্তু বাস্তবতার বিচারে না-ঘটাটাই অধিক তাৎপর্যবহ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের দুস্তর ফারাক চিহ্নিত হয়েছে। একমাত্র বিপ্লবী পার্টি গ্রামকেন্দ্রিক হওয়ায় এ সত্যও ঘােষিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের কাঠামােগত পরিবর্তনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রাম থেকে শুরু হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায়- পার্টি-রাজনীতি ও জাতীয়বাদী আন্দোলনের বিচারে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সফল হলাে। কিন্তু গণআন্দোলনের মধ্যে বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল তা পূরণ হয়নি। উপন্যাস বিশ্লেষণে এ সিদ্ধান্তে পৌছানাে যায়- গণআন্দোলনে জেগে ওঠা সম্ভাবনার নিরিখে নতুন পার্টি-রাজনীতির তত্ত্বায়ন চেষ্টা ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের অন্যতম লক্ষ্য।