বিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রনীতিক আলোচনায় শাসন-বিভাগের প্রাধান্যের অপ্রতিহত অগ্রগতি এবং পাশাপাশি আইনসভার ক্ষমতার অবসান এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ আগের শতাব্দীতে সংবিধান বিশারদদের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল আইনসভার সার্বভৌমত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় আইনসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থাতেই শাসন বিভাগের ক্ষমতার বিস্তার এবং আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাবের অবসান পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইনসভার ক্ষমতার বা আইনসভার দক্ষতার অবসানের অবনয়নের অবস্থাকেই বলা হচ্ছে আইনসভার অবসান। বস্তুত আইনসভার ক্ষমতার অবক্ষয় বা প্রভাব হ্রাসের কথা বলা হয় শাসন-বিভাগের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থাৎ শাসন-বিভাগের সঙ্গে আইন-বিভাগের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাবের অবসানের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়।

আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসে হোয়ার ও ব্রাইসের মত:

হোয়ারের মতে দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আইনসভাগুলির ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেছেন: “… legislatures have declined in certain respects and particularly in powers in relation to the executive.” হোয়ারের অভিমত অনুসারে আইনসভার ক্ষমতা আগের থেকে হ্রাস পেয়েছে তা নয়; শাসন-বিভাগের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাবের হ্রাস ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক উভয় রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের এই সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়। অনুরূপভাবে মন্ত্রিসভা-শাসিত বা রাষ্ট্রপতি শাসিত সকল শাসনব্যবস্থাতেই এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “With the development of mass disciplined political parties and the increasing scope and complexity of executive powers in the twentieth century, it is fashionable to talk of the decline of assemblies.” ব্রাইসও বিভিন্ন দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভাসমূহের ক্ষমতা হ্রাসের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রত্যেক দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা ও নিজস্ব পরিবেশ এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তবুও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কতকগুলি সাধারণ কারণ আছে। লর্ড ব্রাইস তাঁর Modern Democracies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের কতকগুলি সাধারণ কারণ নির্দেশ করা হয়।

(১) জনকল্যাণমূলক দায়িত্বের সম্প্রসারণ: বর্তমানে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কার্যকলাপের সিংহভাগ শাসন-বিভাগই সম্পাদন করে। সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মের বিপুল দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আইনসভা এই ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তাই বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন-বিভাগই ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগই নীতি নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করে। ফলে স্বভাবতই শাসন-বিভাগের সঙ্গে জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন জীবনের গভীর সংযোগ স্থাপিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই জনগণ আইনসভার পরিবর্তে মন্ত্রিমণ্ডলী বা শাসন-বিভাগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং শাসনবিভাগের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এই কারণে আইনসভা যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী ছিল এখন তা অপহৃত হয়েছে এবং আইনসভা শাসন-বিভাগের ভৃত্যের সামিল হয়ে পড়েছে। সিডনি লো মন্তব্য করেছেন: “The show of power is with it. Much of its efficiency has passed to other agents. Its own servants have become, for some purpose, its masters.” এ সঙ্গে র‍্যামসে ম্যুর (Ramsay Muir)-এর অভিমত হল যে শাসন-বিভাগের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ক্যাবিনেটের নায়কতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে।

(২) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি: বিগত দুটি মহাযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা লড়াই এবং নিত্যনতুন সংকট ও আশংকা, আর্থনীতিক ও বহির্বাণিজ্যের সমস্যা প্রভৃতি বহুবিধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ও আর্থনীতিক চাপের মোকাবিলার দায়িত্ব শাসন-বিভাগ গ্রহণ করেছে এবং সম্পাদন করেছে ও করছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসন-বিভাগের ভূমিকাই প্রধান হয়ে উঠেছে। আবার সামরিক ও প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে গোপনীয়তাও রক্ষা করা দরকার। আইনসভার সদস্যদের খোলামেলা আলোচনায় তা সম্ভব হয় না। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে নতুন নতুন সমস্যাদির সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের জটিল সমস্যার চাপ ক্রমশ বাড়ছে। এই অবস্থায় সত্বর সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত ও বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। শাসন-বিভাগই এই সমস্ত দায়িত্ব পালন করে থাকে। শাসনবিভাগ দেশ ও দেশবাসীর মুখ্য কার্যনির্বাহী সংস্থা হিসাবে কাজ করে। এবং জাতীয় জীবনের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে শাসন-বিভাগের এই প্রাধান্যমূলক ভূমিকাকে মেনে নিতে আইনসভা কার্যত বাধ্য হয়। সর্বোপরি জাতীয় সংকট ও জরুরী অবস্থায় আইনসভা প্রয়োজনমত দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। শাসন-বিভাগের ক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধির এও একটি কারণ। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশ ও দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থ সম্পর্কিত সকল বিষয়েই শাসন-বিভাগের প্রধানই কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বর্তমানে রাষ্ট্রপতি হলেন অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। ইংল্যাণ্ডে মন্ত্রিসভাশাসিত শাসনব্যবস্থা কার্যত প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ভারতেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জোহারী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এই বিস্তারকে ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের রাষ্ট্রপতিকরণ’ (Presidentialisation of Prime Minister’s Office) বলে অভিহিত করেছেন।

(৩) দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা: বর্তমানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ ভৃত্যের ভূমিকা পালন করে। রাজনীতিক দলব্যবস্থার বিস্তার, সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতির ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতারাই সরকারে স্থান লাভ করেন। সরকারের স্থায়িত্ব আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। তাই সরকারী দল দলীয় নির্দেশ ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে সতর্ক ও কঠোর হয়। আইনসভার ভিতরে শাসকদলের সদস্যরা দলীয় নির্দেশ অনুসারে কথা বলেন ও কাজ করেন। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার জন্য ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সদস্যদের পক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্যদের অর্থাৎ দলীয় নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা করার সুযোগ থাকে না। সকল ক্ষেত্রে সাধারণ সদস্যগণ দলীয় নেতাদের মতামতকে সমর্থন করতে কার্যত বাধ্য থাকেন। দলীয় নেতাদের অগ্রাহ্য করার অর্থ সেই সদস্যের রাজনীতিক অপমৃত্যু। কারণ বিদ্রোহী সদস্যদের বহিষ্কৃত হওয়ার আশংকা থাকে। তা ছাড়া দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারেও অনিশ্চয়তা থাকে। সর্বোপরি নির্বাচনী প্রচারের ঝক্কি-ঝামেলা, ব্যয়বাহুল্য, সাফল্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা প্রভৃতি থেকেই যায়। দলীয় নির্দেশ মান্য করা অথবা অনিশ্চিত রাজনীতিক ভবিষ্যৎকে বরণ করা, এই দুয়ের মধ্যে আইনসভার সদস্যরা প্রথমটিকেই মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের বলে মনে করেন। তার ফলে আইনসভা শাসন-বিভাগীয় নির্দেশ অনুমোদনের একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। আইনসভাকে সরকারী নীতি ঘোষণার ক্ষেত্র হিসাবে মন্ত্রিসভা ব্যবহার করে। আবার আইনসভাকে ভেঙ্গে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। জেনিংস বলেছেন: in another and more practical sense the Government controls the House of Commons.” এর ফলে আইনসভার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়ে শাসন-বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

(৪) মানুষের মনোভাব: বর্তমানে জনসাধারণের মধ্যে শাসন-বিভাগের ভাবমূর্তিই অধিকতর উজ্জ্বল। এখন শাসন-বিভাগই সকল বিষয়ে যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজনের ব্যবস্থা করে। সরকারী নীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত আছে শাসন-বিভাগের হাতে। সুতরাং শাসন-বিভাগের উপর নির্ভর করাই বাঞ্ছনীয়। অপরদিকে আধুনিক আইনসভা হল বহু সদস্যবিশিষ্ট। এই আইনসভার উপর আস্থা রাখা অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। মানুষের এই মনোভাবও শাসন-বিভাগের প্রভাব প্রতিপত্তিকে প্রসারিত করেছে।

(৫) আইনসভার আলোচনার উপর নিয়ন্ত্রণ: সাম্প্রতিক কালে শাসন-বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষেত্রে আইনসভা হীনবল হয়ে পড়েছে। কারণ এ ক্ষেত্রে আইনসভার হাতের অস্ত্রগুলি কার্যত অকেজো হয়ে পড়েছে। কোন বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে আইনসভার সদস্যদের সুযোগ বা স্বাধীনতা অবাধ নয়। এ ব্যাপারে সভার সভাপতি বা অধ্যক্ষ প্রয়োজনমত আলোচনা বন্ধ, আলোচনার দাবি নামঞ্জুর এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারেন। বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং সরকারী নীতি ও কার্যকলাপের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কিত আইনসভার সমালোচনা বাস্তবে অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়।

(৬) আইন প্রণয়ন ও আর্থিক বিষয়ে ক্ষমতা হ্রাস: বর্তমানে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন শাসন-বিভাগই অধিকাংশ আইনের প্রস্তাব উত্থাপন করে। আইনসভায় উত্থাপিত বিলের মধ্যে অধিকাংশই হল সরকারী বিল। অর্থসংক্রান্ত বিষয়ের উপরও আধুনিক আইনসভার নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে গেছে। এর পিছনে কতকগুলি কারণ আছে। 

  • (ক) আইনসভার সাধারণ সদস্যরা বাজেট প্রস্তাব বা অর্থ বিল উত্থাপন করেন না। মন্ত্রীরাই এ কাজ করেন। 

  • (খ) আর্থিক বিষয়ে জটিলতা, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ-জ্ঞানের অভাব এবং আইনসভার সাধারণ সদস্যের অনীহা ও অনুৎসাহ আইনসভাকে হীনবল করেছে। 

  • (গ) সময়ের স্বল্পতার জন্যও বাজেট প্রস্তাব নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার অবকাশ থাকে না। 

  • (ঘ) দলীয় সংহতি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ সংক্রান্ত বিষয়েও সরকারী দলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। 

  • (ঙ) আর্থিক বিষয়ে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিগুলির ভূমিকা হতাশাজনক। 

  • (চ) ব্রিটিশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার সদস্যরা সরকারের ব্যয় বরাদ্দের দাবি হ্রাস বা বাতিল করতে পারেন, কিন্তু বৃদ্ধি করতে পারেন না।

(৭) অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের জটিলতা, সদস্যদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব, সর্বোপরি সময়ের অভাবের জন্য আইনসভা আইন প্রণয়নের কিছু ক্ষমতা বাধ্য হয়ে শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করে। ফলে শাসন-বিভাগকে কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করতে হয়। একে অর্পিত ক্ষমতা-প্রসূত আইন (Delegated Legislation) বলে। এর ভিত্তিতে আইন-বিভাগের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করে শাসন-বিভাগ নিজের কর্তৃত্বের পরিধি বিস্তৃততর করে। এই অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন বা অধঃস্তন আইন (Subordinate Legislation)-এর এক্তিয়ার যত বাড়বে শাসন-বিভাগের কর্তৃত্বও তত বৃদ্ধি পাবে।

(৮) সদস্যদের অযোগ্যতা: দেশের জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ সাধারণত নির্বাচনের বিড়ম্বনা ও জটিলতার মধ্যে নিজেদের জড়াতে রাজী থাকেন না। ফলে অশিক্ষিত ও অযোগ্য কিন্তু ক্ষমতালিপু ও স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা আইনসভা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে আইনসভার গুণগত যোগ্যতা হ্রাস পায়। বর্তমানে আইনসভার আলোচনা ও বিতর্কের মান অনেক নেমে গেছে। তার ফলে জনসাধারণের কাছে আইনসভার আলোচনা ও বিতর্কের গুরুত্ব ও আকর্ষণ কমে গেছে। আইনসভার প্রতি জনগণের অনাস্থা সূচিত হয়। তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই আইন-বিভাগের প্রাধান্যের জায়গায় শাসন-বিভাগের কর্তৃত্ব কায়েম হয়।

(৯) জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস: জনগণের রাজনীতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হত। কিন্তু বর্তমানে এক্ষেত্রেও আইনসভা হতমান। এখন বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই কারণেও আইনসভার মর্যাদার হানি ঘটেছে।

(১০) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব: আগে আইনসভা সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ সাধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Pressure Groups) ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যাদি সম্পর্কে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকারী নীতিকে প্রভাবিত করার এবং সরকারের সঙ্গে জনগণের সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আইনসভার মর্যাদার হানি ঘটছে। তারফলে জনগণ ও সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে আইনসভা গুরুত্ব হারিয়েছে।

(১১) গণসংযোগের অভাব: বর্তমানে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন-বিভাগই নীতি নির্ধারণ এবং তা প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করে। এই সূত্রে শাসন-বিভাগ নানাভাবে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ ও অভাব-অভিযোগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। স্বভাবতই শাসন-বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সমস্ত ক্ষেত্রে আইনসভার সদস্যদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে না। এর ফলেও আইনসভার গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।

(১২) সদস্যদের স্বার্থপর মানসিকতা: আইনসভার ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাসের জন্য সদস্যদের স্বার্থের মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। সমালোচকদের অনেকের মতে আইনসভার সদস্যদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় বলে তাঁদের মধ্যে স্বার্থপরতার সৃষ্টি হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সদস্যরা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ ও নিজ নিজ আসন সুরক্ষার জন্য মন্ত্রীদের মন যোগানোর কাজে অধিক মনোযোগী হন। মন্ত্রীদের অনুগ্রহ হারালে পরবর্তী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার আশংকা এবং বর্তমানে নানারকম সরকারী সুযোগ-সুবিধা হারানোর আশংকা থাকে। এই কারণে আইনসভার সদস্যরা মন্ত্রীদের অনুগত ও আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েন। এইভাবে সাধারণ সদস্যদের উপর মন্ত্রিসভার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তার ফলে আইনসভার ক্ষমতা ও মর্যাদা বহুলাংশে হ্রাস পায় এবং পাশাপাশি শাসন-বিভাগের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

(১৩) সদস্যদের অযোগ্যতা: আগে আইনসভার সদস্যগণ বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা প্রভৃতি গুণগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন। তাই আইনসভার সদস্য মাত্রেই বিজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতেন। তাঁদের প্রতি জনসাধারণ মর্যাদাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করত। তার ফলে আইনসভার মর্যাদাও বৃদ্ধি পেত। বর্তমানে অবস্থা বদলে গেছে। এখন গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটেছে। রাজনীতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মূল কথা হল সাম্য নীতি। গুণগত যোগ্যতা নির্বিশেষে যে-কেউ আইনসভায় নির্বাচিত হতে পারেন। কোন সাধারণ মানের ব্যক্তি নির্বাচিত হলে আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিচক্ষণতা বা কলা-কৌশলগত জ্ঞান তাঁর থাকে না। এই শ্রেণীর জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা অধিক হলে তাঁরা আইনসভার গুরুদায়িত্ব শাসন-বিভাগের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত্ত থাকাটাই নিরাপদ মনে করেন। জনপ্রতিনিধিরা নিজেরাও তাঁদের মর্যাদা ও ভূমিকা সম্পর্কে শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করেন বলে মনে হয় না। এইভাবে আইন-বিভাগের ভূমিকা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং শাসন-বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লর্ড ব্রাইস জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “The less the country respects them, the less they respect themselves.”

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা সত্ত্বেও, আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস এবং শাসন-বিভাগের কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির কথা সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। বিয়ার (Beer)-এর মতানুসারে আইনসভার পরিবর্তে শাসন-বিভাগের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে একথা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। ব্লনডেল সংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “….the decline of assemblies of communicating mechanisms can scarcely be substantiated.” প্রকৃতপক্ষে সকল দেশের আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে একথা বলা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করেছে। হোয়ারের মতানুসারে মার্কিন কংগ্রেস নিজেকে আগের মতই শক্তিশালী রাখতে পেরেছে। তবে সাধারণভাবে একথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক আইনসভাগুলি তাদের পূর্ব গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়েছে এবং কেবল তর্ক-বিতর্কের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Modern Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “With the development of mass discipline political parties and the increasing scope and complexity of executive powers in the twentieth century, it is fashionable to talk of the decline of assemblies.”