অথবা, আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ কর।
ভূমিকাঃ আধুনিক রাষ্ট্রের মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়ে থাকে এর নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকারের মাধ্যমে। অধ্যাপক লাস্কি যথার্থই বলেছেন, “Every state is known by the right that it maintains.” মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীব। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেই মানুষের জন্ম-মৃত্যু, বুদ্ধি এবং বিকাশ সাধিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরে মানুষ সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে তারা কতকগুলাে অধিকার | ভােগ করে যার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর।
আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারঃ প্রত্যেক ব্যক্তির বা সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন ও মঙ্গল বিধানের জন্যই প্রয়ােজন অধিকারের। রাষ্ট্র এসব অধিকারগুলােকে স্বীকার করে নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। আর রাষ্ট্রের চরিত্র ও প্রকৃতি মানব অধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে বােঝা যায়। ব্যাপক অর্থে নাগরিক অধিকারগুলােকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) নৈতিক অধিকার ও (২) আইনগত অধিকার।
নৈতিক অধিকারের সংজ্ঞাঃ সমাজের ন্যায়বােধ ও বিবেকের দ্বারা সমর্থিত পারস্পরিক দাবিই হল নৈতিক অধিকার। নৈতিক অধিকার সামাজিক নীতিবােধ ও বিবেকের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর পেছনে কোনাে রাষ্ট্রীয় সমর্থন থাকে না। নৈতিক অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র শাস্তি দেয় না, তবে সমাজ ঘৃণা করে। নৈতিক অধিকার লঙ্ঘন করলে বিবেকের দংশন বা লােকনিন্দা সহ্য করতে হয়। যেমনঃ শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা প্রত্যেক ব্যক্তির নৈতিক অধিকার। কেউ এ অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেবে না, তবে লােকে তাকে ঘৃণা করবে। মূলত নৈতিক অধিকার হচ্ছে সমাজের ন্যায়বােধ ও বিবেকের দ্বারা সমর্থিত পারস্পরিক দাবি। নৈতিক অধিকারের মতবাদ ব্যক্তির নৈতিক অধিকারগুলাের ওপর অধিক গুরুত্বারােপ করে।
আইনের পরিবর্তে নৈতিক ভিত্তির ওপর অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ মতবাদ বেশি আগ্রহী। এ মতবাদ অনুসারে- ১. সমাজ থেকেই অধিকারের উৎপত্তি হয়। সমাজ মানুষের মঙ্গলের জন্যই অধিকার স্বীকার করে, ২. অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য জড়িত থাকে। ব্যক্তিসমাজের একজন হিসেবে অধিকার ভােগ করে।
আইনগত অধিকারের সংজ্ঞাঃ রাষ্ট্রকর্তৃক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবি-দাওয়াকে আইনগত বা আইনসঙ্গত অধিকার বলে। এই অধিকার রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয় ও কার্যকরী করার ব্যবস্থা করা হয়। এই অধিকারের পেছনে আইনের সমর্থন আছে। তাই আইনগত অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেয়। জীবনধারণের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, চাকরির অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি আইনগত অধিকার। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠত হয়। এ সময় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের গুরুত্বের কথা প্রচার করা হয়। স্বাভাবিক অধিকারের পরিবর্তে এ সময় উদারনৈতিক চিন্তাবিদগণ অধিকারের আইনগত মতবাদ প্রচার করেন। তাদের মধ্যে Austi, Bentham, Ritchie, Solman প্রমুখ অন্যতম। বেন্থাম দৃঢ়তার সাথে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, “Rights are the fruits of law and law alone.”
আইনগত ও নৈতিক অধিকারের পার্থক্যঃ আইন ও নৈতিকতা এক বিষয় না হলেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আইন চিরাচরিত প্রথা, ধর্মীয় অনুশাসন, বিচারকদের রায় ও আইনসংক্রান্ত গ্রন্থাবলীর সমন্বয়ে সৃষ্টি। আইনগত আধকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে পার্থক্যগুলাে নিয়ে আলােচিত হলাে-
(১) বিষয়বস্তুগত পার্থক্যঃ বিষয়বস্তুর দিক থেকে আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আইনগত অধিকারগুলাে রাষ্ট্রপ্রদত্ত। যেমন- শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ভােটাধিকার, চাকরি লাভের অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, সমালােচনা করার অধিকার ইত্যাদি। অপরদিকে প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য, শিষ্টাচার, সদাচার ইত্যাদি নৈতিক অধিকারের আওতাভুক্ত।
(২) শ্রেণীবিভাগের দিক থেকেঃ নৈতিক অধিকারকে মূলত শ্রেণীবিভাগ করা যায় না। এ অধিকার সবসময় নৈতিক অধিকার হিসেবেই সমাজে স্বীকৃত। অপরদিকে আইনগত অধিকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
(৩) বাধ্যবাধকতার পার্থক্যঃ নৈতিক অধিকার মেনে চলার জন্য কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু আইনগত অধিকার মেনে চলার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত আইন আছে এবং তা জনগণ মেনে চলতে বাধ্য থাকে যা উভয়ের মধ্যে বাধ্যবাধকতার পার্থক্য দেখা যায়।
(৪) সাংবিধানিক পার্থক্যঃ উভয় অধিকারের মধ্যে সাংবিধানিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন- আইনগত নৈতিকতার সম্পর্কে সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান ইত্যাদির কথা বলা আছে সংবিধানে এবং আইনগত অধিকারগুলাে কী কী তাও বলা আছে। কিন্তু সংবিধানে নৈতিক অধিকারগুলাে কী কী? একে কীভাবে মেনে চলতে হবে না মানলে কী কী শাস্তি হবে সে সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা নাই। তাই উভয়ের মধ্যে সাংবিধানিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
(৫) ধারণাগত পার্থক্যঃ ধারণার দিক থেকে আইনগত অধিকার খুবই সুস্পষ্ট। অপরদিকে নৈতিক অধিকার তত সুস্পষ্ট নয়। নীতিবােধ সকলের সমান হয় না। মানুষে মানুষে তারতম্য হওয়াটা স্বাভাবিক। যেমন- ভিক্ষাগ্রহণ করা অনেকের মতে নৈতিক অধিকার। আবার অনেকেই এটাকে নৈতিকতা বিরােধী বলে মনে করে থাকে।
(৬) উৎসের দিক থেকে পার্থক্যঃ রাষ্ট্রই হচ্ছে আইনগত অধিকারের মূল উৎস। আইনগত অধিকার রাষ্ট্র। কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমােদিত। এ অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেয়। অপরদিকে নৈতিক অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনােরূপ শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে না। সুতরাং নৈতিক অধিকারের উৎস বিবেক বা নৈতিকতা।
(৭) শাস্তির বিধানগত পার্থক্যঃ নৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের জন্য কোনােরূপ সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান নেই। এজন্য সমাজ কর্তৃক নিন্দিত হতে হয় এবং বিবেকের তাড়নায় দগ্ধ হতে হয়। অপরদিকে আইনগত অধিকার যেহেতু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রযুক্ত সেহেতু এ ধরনের অধিকারে কাউকে বাধা প্রদান করলে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান করা হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অধিকারের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। আইনগত ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে উপযুক্ত পার্থক্য থাকলেও এ কথা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রেনৈতিক অধিকার ও আইনগত অধিকারের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। মূলত নৈতিক অধিকার আইনগত অধিকারকে পরিপুষ্ট করে।
Leave a comment