ভারতে ইংরেজদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা তথা ভারতে কুটিরশিল্প যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করার পর দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শিল্পায়ন বিরােধী বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে। তারা ইংল্যান্ডের শিল্প কারখানায় উৎপাদিত সামগ্রীর দ্বারা ভারতের বাজারগুলি ছেয়ে দেয় এবং ভারতকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে। এর ফলে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের চিরাচরিত সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনা ‘অব শিল্পায়ন’ (De-industrialisation) নামে পরিচিত।
অব-শিল্পায়নের ফলাফল
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযােগে ব্রিটিশরা এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে সমর্থ হয়।
[1] বেকারত্ব: দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর কাজ হারায়। নরেন্দ্রকৃয় সিংহের মতে, শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল। কর্মচ্যুত হওয়ার ফলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে, “যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে ও শিল্পজ অংশ কমতে থাকে,তবে তাকে অব-শিল্পায়ন বলে।”
[2] কৃষির ওপর চাপ: অব-শিল্পায়নের ফলে জমির অনুপাতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহে চাপ বাড়ে। দেশে কৃষিজীবী ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
[3] গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন: অব-শিল্পায়ন ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে সেখানে অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হয়। অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। গ্রামে কৃষি মরসুম ছাড়া অন্য সময় মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে মানুষের গড় আয় যথেষ্ট কমে যায়।
[4] নগরজীবনের অবক্ষয়: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা, মুরশিদাবাদ, সুরাট, মসুলিপট্টম, তাঞ্জোর প্রভৃতি নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অবক্ষয় শুরু হয়।
[5] কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতবর্ষ একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ভারতের কাঁচা তুললা, কাঁচা রেশম, নীল, চা প্রভৃতি কাঁচামাল নিয়মিত বিলাতের কারখানাগুলিতে চলে যেতে থাকে। এর ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে গতি আসে।
[6] বিলাতি পণ্য আমদানি: দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারত একটি রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। বিলাতের ম্যাঞ্চেস্টার, ল্যাঙ্কাশায়ার ও অন্যান্য স্থানের শিল্পজাত পণ্য ভারতে আমদানি শুরু হয়। কেবল সুতিবস্ত্র নয়, রেশম ও পশমজাত দ্রব্য, লােহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলােয়ার, খােদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতির যথেচ্ছ আমদানির ফলে দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
[7] দারিদ্র্য বৃদ্ধি: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
ড. বিপান চন্দ্রের মতে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যনীতি ব্রিটিশ শিল্প ও শিল্পপতিদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়েছিল। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীকে জীবনধারণের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির জন্য ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং ভারত থেকে ব্রিটিশ পণ্যের জন্য কাঁচামাল আহরণ। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস মনে করেন যে, অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক ‘অলীক কল্পনা’ বা মিথ। কিন্তু ড. বিপান চন্দ্র, ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. অমিয় বাগচি, ড. তপন রায়চৌধুরী প্রমুখ অব-শিল্পায়নকে একটি বাস্তব ঘটনা বলে মনে করেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের রাজস্ব ব্যবস্থার পরিচয় দাও।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অব-শিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলােচনা করাে।
Leave a comment