যে গল্পে অলৌকিক রহস্য, অস্বাভাবিক বা অপ্রাকৃত ভাব একটা শিহরণ সৃষ্টি করে ভয়াবহ এবং রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করে তাকে অতিপ্রাকৃত গল্প বলে। শ্রীশচন্দ্র দাশের মতে, “যে গল্পে অতি লৌকিক রহস্য আচ্ছন্ন করিয়া রাখে অথবা উহারই মৃদু শিহরণে গল্পটি রহস্য মধুর বা ভয়াবহ রূপকান্তি লাভ করে তাহাকে অতিপ্রাকৃত গল্প কহে।” এই শ্রেণির গল্প পাঠে পাঠকচিত্ত বাস্তব ও পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ থেকে অস্বাভাবিক বা অতিপ্রাকৃত কিছু উপলব্ধি করে এক রহস্যময়তায় নিমজ্জিত হয়।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতি সহজ কথা বা কাজকর্মের মধ্যে অবাস্তব বা অতি রহস্যের মায়াজাল বিস্তার করে আকস্মিক এবং সাময়িক মনোবিকার ঘটিয়ে থাকে, তাকে অবলম্বন করে বিশেষ শিল্প সৌকর্যের বুননে, নিবিড় ভঙ্গিতে, ভয়ার্ত ও কৌতূহলী করে তোলে অতিপ্রাকৃত ছোটোগল্প।

মানুষের জীবনে অতিপ্রাকৃতের সমন্বয়সাধন অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে যে ব্যঞ্জনা রবীন্দ্রগল্পে প্রথিত তা একটা ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে পাঠককে অতীন্দ্রিয় জগতে নিয়ে যায়। এ জাতীয় গল্পকেই আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সার্থক অতিপ্রাকৃত গল্প রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ একটি উল্লেখযোগ্য অতিপ্রাকৃত ছোটোগল্প।

অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে ক্ষুধিত পাষাণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিপ্রাকৃত গল্পগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মায়াজাল বিস্তার করে আছে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটিতে। প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের এই বিশেষ ধরনের গল্পের এমন কলাকৌশল, রহস্য, নিবিড় বর্ণনাভঙ্গি, অপরূপ কল্পনার ঐশ্বর্য এবং এর সাথে অবাস্তব, অবিশ্বাস্য, অতিলৌকিক রোমান্সের সুর প্রবাহ বিদ্যমান।

গল্পটির পরিবেশ রচিত হয়েছে শুস্তা নদীর তীরে বরীচ নগরে আড়াইশ বছর আগেকার তৈরি দ্বিতীয় মামুদের ভোগবিলাসের নির্জন প্রাসাদে। লেখকের ভাষায়-

“অনেক অতৃপ্ত বাসনা অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইয়াছে। সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তর খণ্ড ক্ষুধার্ত হইয়াছে, সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালাইত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়।”

এমনই রহস্যময় পরিবেশের মধ্যে লেখকের কল্পনা বিচিত্র সীমারূপ পরিগ্রহ করে। সেই অবাধ কল্পনা ও সংগীত প্রবাহের মধ্যে যেন অবাস্তব কোথাও কিছু নেই। তারপরেও মানবমনে ভয় এবং শরীরে নতুন শিহরণ জাগায়। তুলার মাহুল আদায়কারী নির্জন প্রাসাদবাসী যে ভদ্রলোক গল্পের নায়ক- সূর্যাস্তের পরক্ষণে সে আর নিজের মধ্যে থাকে না। সেই রহস্যময় প্রাসাদটি তার চারপাশে একটি ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তাকে আহ্বান করে। তুলার মাশুল আদায়কারীর কাছে এক একটি রাত এক একটি স্বপ্ন জগতের মতো অতিবাহিত হয়। এ স্বপ্ন জগৎ হয়তো কখনো শেষ হতো না যদি না প্রতি প্রভাতে জনশূন্য পথে পাগল মেহের আলী ‘তফাৎ যাও’ বলে চিৎকার না করতো। করিম খাঁর সতর্কতা সত্ত্বেও প্রতি রাতে গল্পকথক নির্জন প্রাসাদটিতে গমন করতো অন্য এক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে। কেননা অনেক বছরের পুরনো প্রাসাদটির মধ্যে সে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পেত। যেমন-

“আবার সেইদিন অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম, কে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে যেন আমার খাটের নিচে, মেঝের নিচে এই বৃহৎ প্রাসাদের পদার্পণ ভিত্তির তলবর্তী একটি আর্দ্র অন্ধকার ঘরের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া, তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও।”

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি কৌশলের দিক থেকে অনবদ্য ও অনন্য। গল্পের প্রারম্ভিক ভূমিকা স্বল্প পরিসর। সমাপ্তি ও আকস্মিক অন্য একটি গাড়ি আসবার অবসরে স্টেশনের বিশ্রাম কক্ষে গল্পটি বর্ণনার সূত্রপাত এবং আরেকটি গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে গল্পটির আকস্মিক সমাপ্তি। এই গল্পে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ একান্তভাবে চিত্তবিকারজনিত নয়। পুরাতন প্রাসাদের অন্তঃপুরে বাসনাজালে আবদ্ধ দেহহীন লালসাময় রূপসীদের অদৃশ্য অবোধ প্রভাবের বলে যেখানে একাধিক রাত যাপন করেছে তার শরীর মন অল্পে অল্পে সেই প্রাসাদের মোহগ্রাসে জীর্ণ হতে হতে অবশেষে জীবন বা বুদ্ধি তিরোহিত হয়ে মৃত্যু অথবা পাগলে রূপান্তরিত হয়েছে। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ পাগলা মেহের আলী। তুলার মাশুল আদায়কারীও এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। লেখকের ভাষায়-

“সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না ক্রন্দনও থামে না, আমি নিষ্ফল পরিতাপে ঘরে ঘরে অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম কেহ কোথাও নাই; কাহাকে সান্ত্বনা করিব। এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার। এই অসমাপ্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উত্থিত হইতেছে।”

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির কাহিনীর বর্ণনাভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুর রহস্যময়তা একটি রসঘন শিহরিত পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ভৌতিক পরিবেশ, জগৎ নির্মাণ, ভয় ও শিহরণের সঞ্চার, বাস্তবের সাথে অবাস্তবের একটি মায়াজাল সৃষ্টি অতিপ্রাকৃত গল্পেরই সার্থক রূপায়ণ। তাই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্থক সৃষ্টি।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।