সমগ্র বাংলা ছোটোগল্পের জগতে রবীন্দ্রনাথের অতিথি এক অপূর্ব সৃষ্টি। তার সমকক্ষ কোনও গল্প আর আছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতি ও মানুষের এমন নিবিড় সংযোগ বিশেষত বাংলা সাহিত্যে বড়ো বিরল। এর কাহিনি চরিত্র দৃষ্টিপট এমন সাবলীল ভঙ্গিতে বিশ্লেষিত হয়েছে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর। ছোটো ছোটো বাক্যবিন্যাস, সুষম ও যথাযথ শব্দচয়ন গল্পটিকে অনন্য মহিমায় ভূষিত করেছে। বিশেষত গল্পের নায়ক তারাপদর কার্যকলাপ এমনই মর্মবিদারী অথচ স্বাভাবিক বড়ো উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। হয়তো কবির অমর লেখনীর স্পর্শে তারাপদ বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে চির অমর হয়ে থাকবে তথাপি বিধাতার আশীর্বাদ না বর্ষিত হলে এমন অপরূপ সুষমা মণ্ডিত চরিত্র পাওয়া বড়ো দুষ্কর। অর্থাৎ একমাত্র বিধাতার ইচ্ছা অনুযায়ী তারাপদর মতো মানুষকে আমরা সাহিত্যের মধ্যদিয়ে বাস্তব জগতে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হই। তারাপদর কাজকর্ম বড়ো হৃদয়বিদারক বলেই গল্পের রস-পরিণাম বিশেষ সুরে ও সুর মূর্ছনার সমাপ্ত হয়েছে, ট্র্যাজেডির একটা করুণ চিত্র আমাদের ব্যথিত করে কিন্তু বিভ্রান্ত করে না।
একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, তারাপদর মতো চরিত্র রবীন্দ্রনাথ আর সৃষ্টি করেননি। হয়তো নীলকণ্ঠের সঙ্গে তারাপদর একটা আত্মীক যোগ আছে কিন্তু নীলকণ্ঠ প্রকৃতি প্রেমিক হলেও তারাপদর মতো এমন মতবন্ধন মুক্ত নয়। কোনোমতেই তারাপদকে নষ্টনীড়ের অমলের সঙ্গে, একরাত্রি গল্পের সেকেন্ড মাস্টারের সঙ্গে কিংবা পোস্টমাস্টার গল্পে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। কারণ তাদের সঙ্গে তারাপদর জীবনযাত্রা মানসাভিলাসের বিস্তর ব্যবধান। তারাপদই একমাত্র উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রমী চরিত্র। ‘অতিথি’ গল্পের নায়ক পনেরো ষোলো বৎসরের বালক তারাপদই সমগ্র ঘটনার মূল ভূমিকায় অধিষ্ঠান করে আছে। তাকে কেন্দ্র করে গল্পের সমস্ত কাহিনি, চরিত্র, ভাবধারা আবর্তিত হয়েছে। লেখক রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য ভঙ্গিতে চিরপথিক তারাপদর জীবনের বিশেষ একটা খণ্ডিত মুহূর্তকে অবলম্বন করে গল্পের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। বিশেষ মুহূর্তটি স্থান প্রকৃতির প্রতি তারাপদর বিশেষ অন্তরঙ্গতা বোধ, যার হাতছানিতে সাংসারিক সমস্ত স্নেহ, মোহ-মায়ার বন্ধনকে ছিন্ন করতে দুর্বার গতিতে তারাপদ ধেয়ে যায়। তাই এটাকে শুধুমাত্র গল্প হিসাবে চিহ্নিত না করে জীবন দর্শনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, আর সেটা বাস্তবায়িত হয়েছে তারাপদকে দিয়েই।
তারাপদর স্বল্পকালীন জীবন পরিক্রমার মধ্য দিয়েই গল্পের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব মূর্ত হয়ে উঠেছে। গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে তারাপদর বাল্য-কৈশোরের নির্বিকার নির্লিপ্ত চিত্তের ঔদাসীন্য ভাবধারা। তবে কাঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণার মধ্যস্থতায় তারাপদর অতীত জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা এইরূপ—সে মারাবার চতুর্থ পুত্র এবং বাল্য বয়সেই পিতৃহীন। মা ও ভাইবোনের আদরে স্নেহে, পাড়া প্রতিবেশীর প্রশ্রয়ে সে বড়ো হয়ে উঠেছে। ঠিক এমন এক মুহূর্তে কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা বিদেশি যাত্রাদলের সঙ্গে মিশে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় বহু অনুসন্ধানের পর মা-ভাইয়েরা ও প্রতিবেশীরা একযোগে তাকে ফিরিয়ে আনলেও পালিয়ে যাবার মনোবৃত্তিকে কিছুতেই তারা দমন করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা এক সময়ে তারাপদকে সংসারে প্রতিষ্ঠা করবার অনন্য ত্যাগ করে। এরপর থেকেই তারাপদ বন্ধনহীন হয়ে শুরু করে তার নতুন জীবনের পদার্পণ। যাত্রাদলের পালা সাঙ্গ করে পাঁচালি গানের দলে অংশগ্রহণ তবে ক্ষণিকমাত্র। তারপর বিশেষ কৌতুহলবশত কিছুদিন জিমন্যাষ্টিকের দলে গিয়ে খেলাধুলা শিখে এসেছে। তারাপদ তো কোথাও থেমে থাকার পাত্র নয়। তাই এখানেও তার দীর্ঘকাল থাকা হল না। তাই সমস্ত ছেড়ে একদিন সে সখের যাত্রা দেখার জন্য একাকী নন্দীগ্রামে পাড়ি দিয়েছিল, তখনই মতিবাবু, অন্নপূর্ণা ও চারুশশীর সঙ্গে নদীতীরে তার সাক্ষাৎ ঘটে।
লেখক গল্পের প্রথমেই বিশেষ কৌশলে তারাপদর নির্লিপ্ত উদাসীন বন্ধন মুক্ত স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তবে সে উদাসীন হলে কোনও কর্মে সে অপটুতার পরিচয় রাখেনি। বহু প্রয়াসে এবং আত্মপ্রচেষ্টার দ্বারা যে-কোনো কর্ম স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। এ সম্বন্ধে বিশেষ আংশিক পরিচয় মেলে মতিলালবাবুর নৌকায় যাত্রাকালে—মাঝিদের রান্নায় সাহায্য করেছিল, দু’একবার রান্না করে দেখিয়ে দিয়েছিল সেও রান্না করতে জানে। তারপর মাঝিদের সঙ্গে নৌকা হাল ধরে নিজের পটুতার পরিচয় দিয়েছিল। তাছাড়া তারাপদর কতকগুলি সহজাত গুণ ছিল সেটাকে মিশুকে চরিত্র হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার দ্বারা অতি সহজেই সে যে-কোনো মানুষের মন জয় করতে পারতো। যাত্রার দলে বুকে অধিকারীর মন সে অনায়াসে জয় করে নিয়েছিল। গানের প্রতি বিশেষ ঝোঁকবশত পাঁচালি গানের দলে বুকে সে লব কুশের পালা আয়ত্ব করেছিল। নৌকার উপর সুমিষ্ট কণ্ঠে গান গেয়ে মতিবাবু অন্নপূর্ণার চারু শশী মাঝি মাল্লাদের এক নিমেষেই মন জয় করেছিল। জিমনাস্টিকের দলে ঢুকে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর তাগিদে খেলা শেখা, নৌকারোহী দোকানির সঙ্গে মিশে মেলায় পানের খিলি বিক্রি করা শিখেছিল। বিশেষ কৌতূহলবশত স্বাভাবিক প্রবণতায় বাঁশি বাজানো শিখে করুণ সুর মূর্ছনায় শ্রোতাদের মন মুগ্ধ করে দিত। তারাপদ তো আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়—“যে-কোনো দৃশ্য তাহার চোখের সম্মুখে আসে তাহার প্রতি তারাপদর সকৌতূহল দৃষ্টি ধাবিত হয়, যে-কোনো কাজ তাহার হাতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাতেই সে আপনি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তাহার দৃষ্টি তাহার হস্ত তাহার মন সর্বদাই সচল হইয়া আছে; এইজন্য সে নিত্য সচলা প্রকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন, অথচ সর্বদাই নিরাসক্ত।”
গল্পের সূচনা এবং পরিণত সমস্ত তারাপদকে ঘিরেই। খণ্ড খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে তারাপদর মানস বৈশিষ্ট্যের সূত্রগুলি সম্পর্কে অবহিত হলেও এটাই তার জীবনের সর্বশেষ কথা নয়। মানব জীবন যেমন তার কাছে বিশেষ আকর্ষণের বস্তু ছিল ঠিক তেমন প্রকৃতির রূপ রস সৌন্দর্য তার বিশেষ উপভোগের বস্তু ছিল। কিন্তু কোনও বিষয়েই আবদ্ধ থাকা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই সে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে। কারণ তারাপদর বিধাতা পুরুষ—“জন্ম নক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে ।” তাই সে চিরপথিক, এই পথ চলতেই তার আনন্দ। কালের অমোঘ নিয়মে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গায়িত জীবনোচ্ছাসের মধ্য দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্ভার মনুষ্য চিত্তে বাসা বাঁধে একটা আসত্তির জগৎ রচনা করে আবার পরক্ষণেই কালের দুরন্ত তাড়নায় তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে এটাই পরখ করেছে পরিণতি অংশে কেবল মাত্র শূন্যতা এসে ধরা দিয়েছে। কিন্তু তারাপদ তাদের চেয়ে ভিন্ন পথের যাত্রী। নির্বিকার ঔদাসীন্যে আত্মভোলা জীবনদৃষ্টি দিয়ে মানুষ সমাজ এবং প্রকৃতির আঙিনায় সে বিচরণ করেছে, মনুষ্য লোকের সুখ-দুঃখ ব্যথা বেদনা স্নেহ-মায়া প্রেম-প্রীতি ক্ষণিকের জন্যে তাকে বেঁধে রাখলেও দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। অকাতরে বিদায় দিয়েছে। এই বিদায়ের মধ্য দিয়ে তারাপদর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মতিবাবুর গৃহে আশ্রয় পাবার পর আপন প্রতিভার বলে সবই জয় করলেও চারু শশী যেন তার কাছে দুর্বোধ্য রয়ে যায়। বিশেষ করে সোনামণির সঙ্গে যখন সে কথাবার্তা বলতে থাকে, তবুও চারু শশীকে জয় করার জন্য তারাপদ আপ্রাণ চেষ্টা করে ধীরে ধীরে চারুকে সম্পূর্ণ ভাবে অধিকার করে বসল, চারুর মনে প্রণয়ের উদয় হয়। মতিবাবু অন্নপূর্ণা সৎপাত্রে কন্যা দান করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আয়োজন প্রস্তুত করতে থাকে, কিন্তু তারাপদকে বাঁধবে কে ? পৃথিবীর এমন কোনও কঠোর বন্ধন নেই যে তারাপদকে বেঁধে রাখতে পারে। বিবাহের আয়োজন যখন প্রস্তুত তারাপদর বিধাতাপুরুষ তাকে ডাক দিল নাগবাবুদের বিখ্যাত রথযাত্রার মেলাতে। স্নেহ প্রেম বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র ‘বন্ধন’ কে ছিন্ন করে সবার অলক্ষে বর্ষার রাত্রেই বেরিয়ে পড়ে রথযাত্রার উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে থাকে মতিবাবু অন্নপূর্ণার সাধবাসনা আর চারুশশীর জীবনের প্রথম প্রণয়। যাদের কাছে তারাপদ চিরকালের আপন জন হয়ে বিরাজ করতে পারতো তাদের কাছে কেবলমাত্র ‘অতিথি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইল।
তারাপদর ক্ষণিক উপস্থিতি, পরক্ষণেই অন্তর্ধান, শুধুমাত্র গল্পে নয়, আমাদের মানসলোকে একটা চিরপ্রেক্ষাপট চেনা করে গেছে। রবীন্দ্র কবিতার ভাষায় বলতে হয়—
‘ধরণির
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্ব প্রান্ততীরে
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি দিব। সবে
কহে যেতে নাহি দিব।
এই আকুল আর্তি কেবল চারু শশীর নয়, সমস্তকে অতিক্রম করে সংসারী মানুষের মানসলোকে ধ্বনিত হয়েছে। বন্ধন মুক্ত তারাপদ, প্রকৃতি প্রেমিক তারাপদ, মিশুকে তারাপদ অনন্য প্রতিভার অধিকারী তারাপদ, আমাদের কাছে নিত্যকালের পথিক হয়ে রইল।–“স্নেহ-প্রেম বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র বন্ধন তাহাকে চারিদিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বে সমগ্র গ্রামের হৃদয় মাসি চুরি করিয়া একদার বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণ বালক আসক্তি বিহীন উদাসীন জননী বিশ্ব প্রকৃতির নিকট চলিয়া গিয়াছে। এখানেই তারাপদ চরিত্রের অনন্যতা স্বীকৃতি পেয়েছে।
Leave a comment