“আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী….” অতিথি গল্পের মূল ভাববস্তু বোধকরি এই ছত্র কয়টির উপর দাঁড়িয়ে। অনুরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পটিকে যদি এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় তাহলে এদের মধ্যে যে অন্তরঙ্গ মিল আছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কর্মস্থানের সমস্ত মায়া-মমতা-স্নেহ ভালোবাসা, এমনকি রতনের মর্ম বিজড়িত করুণ ডাক পোস্টমাস্টারকে থামাতে না পেরে প্রবহমান নিত্যকালের বুকে তার চিরবিদায় আমাদের অন্তরে অতৃপ্তি মতো জাগিয়ে রাখল, ‘অতিথি’ সে তুলনায় তার উত্তরসূরী। তবে পোস্টমাস্টার ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কিন্তু অতিথির তারাপদ তার স্বভাবজাত, যা জন্ম হতে সংগ্রহ করে পৃথিবীর বুকে এসেছিল কারুর দ্বারা সে অনুপ্রাণীত নয়। সর্বদা সুদূরের ডাক, তাকে বারে বারে ঘর ছাড়া করে ছেড়েছে। এমন কোনও কঠিন বন্ধন নেই যে তাকে বাঁধতে পারে।” আমার এই পথ চলাতেই আনন্দর মতো পথিক তারাপদ একস্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে বেড়িয়েছে, হরিণশিশুর মতো সে ছিল বন্ধন ভীরু প্রকৃতির অব্যক্ত রূপের মাঝে অবগাহন করতে করতে সে ফিরে বেড়িয়েছে অরূপের সন্ধানে।

সমগ্র অতিথি গল্প জুড়ে তারাপদ সম্পর্কে যে সমস্ত স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য আমরা প্রত্যক্ষ করি তা সত্যিই মনুষ্য সমাজে দুর্লভ। সে সৌন্দর্যের রূপ অমিয়তায় মুগ্ধ। সমস্ত কাজে তার আশ্চর্য পারিপাট্য, ছিল নির্মল তপস্যায় এবং সুন্দরের পূজারি হয়ে পেয়েছিল অজেয় রূপ, তাঁর সরলতা, ভাবুকতা, সমস্ত কথায় অদ্ভুত হাসির সমাবেশে মানবদেহধারী হয়ে এমন কেউ নেই যে বিমুগ্ধ না হয়ে থাকে। অতি অল্পে সবাই তাকে ভালোবেসে ফেলে, তাঁকে স্নেহের নিগূঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখতে চায় কিন্তু পারে না। লেখকের কথায় “কিন্তু বন্ধন, এমনকি স্নেহ বন্ধনও তাহার সহিল না, তাহার জন্ম নক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে।” তারাপদর চরিত্রে এই বন্ধনহীন গৃহহীন ভাবধারা দুদিক থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্যে আত্মহারা হয়ে সে ঘর ছেড়েছে, সে চায় কোনও বুদ্ধি বিবেচনা নয় কোনোরকম হিসাবের দ্বারা নয়, সম্পূর্ণ অন্তরাত্মার তাগিদে প্রকৃতির সাবলীল সৌন্দর্যকে গভীর ধ্যানের দ্বারা উপলবদ্ধি করা। তাই সে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে বেড়িয়েছে। বন্ধনহীন হয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে তার একটা বিশেষ ধারণা তৈরি ছিল। তার উৎস্য আবিষ্কারে অনুপ্রাণীত হয়ে জীবনস্রোতের মধ্য দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে। তারাপদর এই চলিষ্ণু জীবন ধর্ম তাকে চিত্রপথিক হিসাবে আখ্যাত করেছে।

সাধারণ মানুষের চোখে যা ধরা পড়ে না তারাপদর আত্মীক তন্ময়তার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠত। প্রকৃতির বুক থেকে উঠে আসা নানারকম ধ্বনি, সংগীত, রূপ, সৌন্দর্য সমস্তই তারাপদ একনিষ্ঠ চিত্তে উপভোগ করত,—“গাছের ঘন পল্লবের উপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা পড়িত আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতর মাতৃহীন দৈত্য শিশুর ন্যায় বাতাস ক্রন্দন করিতে থাকিত, তখন তাহার চিত্ত যেন উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিত। নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহর বহুদূর আকাশ হইতে চিলের ডাক, বর্ষার সন্ধ্যায় ভেকের কলরব, গভীর রাত্রে শৃগালের চিৎকার ধ্বনি সকলেই তাহাকে উতলা করিত।” তাই অতিথি রূপে তারাপদর এই বিশ্ব-সংসারে পদচারণা, সকল বন্ধন ছিন্ন করে প্রকৃতির সৌন্দর্য রাশির মধ্য দিয়ে তার চির আভাস গড়া। ঠিক এই কারণে বোধ হয় সংসারী মানুষের সঙ্গ তার ভালো লাগতো না। এবং পরিবারের আর পাঁচজনের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মতিলাল বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর অতি একাত্ম হয়ে তার যে বন্ধন মুক্তির ডাক আসে তা অতি বিস্ময়কর। তারাপদ সাধারণের মতো পাঁচজনের সঙ্গে মিশেছে কিন্তু থেমে থেকে সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মাঝে নিজেকে বেঁধে রাখেনি—“তারাপদ এই অনন্ত নীলাম্বরবাহী বিশ্ব-প্রবাহের একটি আনন্দোজ্জ্বল তরঙ্গ—ভূত ভবিষ্যতের সহিত তাহার কোনও বন্ধন নাই— সম্মুখাভিমুখে চলিয়া যাওয়াই তাহার একমাত্র কার্য। এ সেই চির পাথকের কণ্ঠে শোনা অমর বাণী—আমি, মানুষের মাঝে হারাতে চাই মানুষ হয়েই কোনো জন্মে জন্মে প্রকৃতি মোরে গ্রহণ করে যেন।

কাঠালিয়ায় মতিলালবাবুর গৃহে এসে অন্নপূর্ণার স্নেহ ও চারুর চপলতায় ক্ষণিকের জন্য প্রকৃতির কোল থেকে তারাপদ বিচ্যুৎ হলেও তাকে সংসারের নিগূঢ় আবেষ্টনে বেঁধে রাখা যায়নি। প্রকৃতির প্রতি তারাপদর আসক্তি তাকে তো চির পথিক করে তুলেছে, চলমান নদীর স্রোতের মতো তার যাত্রা কোথাও শ্যাওলা রূপী মোহমায়া পথ আগলে দাঁড়ালেও তা ক্ষণিক মাত্রা—সমুদ্ররূপী প্রকৃতির সৌন্দর্যরূপীর মাঝে তাকে বিলীন হতেই হবে। “একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণ বালক আসক্তি বিহীন উদাসীন জননী বিশ্ব প্রকৃতির নিকট চলিয়া গিয়াছে।” এখানেই অতিথির সার্থকতা। তারাপদকে ঘিরে মতিলালবাবু অন্নপূর্ণা চারুশশী, সোনামাসির কত সাধ আল্লাদ। কিন্তু এই সমস্ত স্নেহের বন্ধনকে নির্বিকার চিত্তে দূরে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে চির পথিক রূপে। যেমন করে একদা অন্তরের তাগিদে, বিদেশি, যাত্রার দলে, পাঁচালি গানে, জিমনাস্টিকের দলে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে অংশগ্রহণ করে আবার বিদায় নিয়েছিল, অনুরূপ, অন্নপূর্ণার পুত্র স্নেহ, চারুর প্রেম সমস্তকেই সে এক নিমেষেই ত্যাগ করতে পেরেছিল কেবলমাত্র তার অন্তরের বন্ধনমুক্ত অভিলাসের তাগিদে। মতিলাল তারাপদকে অতিথি রূপে পেয়েও তাকে চির আপন করে রাখার জন্যে সম্মান, সমাদর, ভালোবাসা, স্নেহ মমতা সমস্তই দিয়েছিল। কিন্তু তারাপদ নিস্পৃহ চিত্তে সমস্তই ত্যাগ করে বুঝিয়ে দিয়েছে—সে ‘অতিথি’ রূপী চিরপথিক। এছাড়া তার অন্য কোনও পরিচয় নেই। তাই জমিদার ও জমিদার গৃহিণীর সুরে সুর মিলয়ে বলতে মন চায়—“হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে তুমি কারে চাহিয়া ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া।।”

যেহেতু একটা ভাবকে কেন্দ্র করে অতিথি গল্পের অবতারণা, তাই একে ভাবকেন্দ্রিক গল্প হিসাবে চিহ্নিত করাই শ্রেয়। বিশেষ সময়ে স্বল্পকালের জন্য উপস্থিতি কোনও ব্যক্তিকে যদি অতিথি হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে এ গল্পের নায়ক তারাপদই একমাত্র অতিথি। যারে জন্মক্ষণে বিধাতা পুরুষ ঘর ছাড়ার মন্ত্র লালাটে লিখে দিয়েছিল। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে মা দাদার স্নেহে লালিত। বিদেশি যাত্রাদলে যোগ দেয় অভিনয় শেখার তাগিদে, বাড়ির কোনও বন্ধন তাকে বাঁধতে পারলে না। অভিনয় শিখেও সেখানে সে দীর্ঘদিন স্থায়ী হল না। তারপর একে একে পাঁচালি দল। জিমনাস্টিকের দল, মতিলালবাবুর জমিদার গৃহে সমপরিমাণে সমাদ্রিত হয়েও কোনো বন্ধনই তাকে আটকাতে পারল না, জীবনের সে পরম মোহনীয় অবস্থা চারুর সঙ্গে বিবাহের ঠিক প্রাক মুহূর্তে এক অজানা আহ্বানে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে সে আবার ঘর ছাড়া হয়। পথকে চিরসাথী করে প্রকৃতির সৌন্দর্যরাশি উপভোগ করতে করতে মানুষের ঘরে ক্ষণিকের জন্য অতিথি রূপে তার আগমন এবং বিদায় গ্রহণ এটা তার ভাগ্য দেবতার নির্দেশ মাত্র, তাই সে অতিথি মাত্র তার আর কোনও বড়ো পরিচয় নেই।

অতিথির প্রাণপুরুষ তারাপদ। জাগতিক স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালোবাসায় তার সুখ নেই। বিধাতাপুরুষ হয়তো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সমস্তই নিমিত্ত মাত্র, চিরকালের অমূল্য জিনিসকে সে লাভ করার প্রয়াসে ছুটে বেড়িয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে প্রকৃতির বুকে, পথচলার মাঝে অজস্র মানুষের পরিচয় গ্রহণ এবং ক্ষণিক আতিথেয়তা লাভ করে আবার যাত্রা শুরু। অন্তহীন চলা, যুগ-যুগান্তরের কাল পরিক্রমায় প্রকৃতি মানবশিশুকে এভাবেই আতিথেয়তা দেয়—তাকে স্নেহ মমতায় সৌন্দর্যে মোহিত করে আবিষ্ট রাখে। প্রকৃতির এই অকৃপণ আতিথেয়তা তারাপদ লাভ করেছিল, যেখানে অন্নপূর্ণার স্নেহ মমতা, আদর যত্ন কণামাত্র স্পর্শ করতে পারে না। অন্নপূর্ণার স্নেহ মমতা কেবল উদ্দেশ্য প্রণোদিত মাত্র, আর প্রকৃতির এই অন্তহীন স্নেহ মমতার সৌন্দর্যময় দানই হল অকৃপণ দান। যা কোনও কিছু প্রত্যাশা করে নয়, সে কেবল মনুষ্য জগতের মায়াময় বন্ধন কাটিয়ে ঘর ছাড়া আনন্দ উপভোগ করে। তারাপদ সেই সুরে সুর মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে চির অতিথি রূপে চিহ্নিত হয়ে রইল।

সমগ্র গল্পে তারাপদর ঘন ঘন দিক পরিবর্তন বড়োই উপভোগ্য হয়ে উঠলেও অন্তরের তাগিদে বারে বারে তার বন্ধন ছেঁড়ার ডাকে সাড়া দেওয়া পাঠকচিত্তকে বড়ো বিমর্ষ করে তোলে বিশেষত চারু যখন সমস্ত মান অভিমান ত্যাগ করে মনে প্রাণে তারাপদকে একান্ত আপনার করে পাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছে। তাদের বিবাহ আসন্ন, এমনই এক মিলন মুহূর্তে তারাপদর অন্তর্ধান যে বিচ্ছেদ রাগিণী করুণ সুরে বেজে উঠলো তাতে আমাদের অন্তরকেও বিষাদে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তাই তো রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বলতে হয়—

আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে 

বসন্তের বাতাসটুকুর মত। 

মেখে ছুয়ে গেল কুঁয়ে গেল রে 

ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ৷৷

সে চলে গেল বলে গেল না 

সে কোথায় গেল ফিরে এল না।

—এই ‘ফিরে এল না’—একথার হাহাকার কেবল চারু শশীর ক্ষেত্রে নয়। সংসারের সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোগ্য। ভাবুক খেয়ালি তারাপদর এই নিরুদ্দেশ যাত্রার মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছে। অতিথি রূপে তার ক্ষণিক আগমন। এবং এখানেই ‘অতিথি’ গল্পের সার্থকতা।