ভূমিকা: প্রবহমান সময়ের পরিক্রমায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [১৮৬১-১৯৪১] কবি মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে এবং তাঁর নাট্যরীতিরও পটভূমি পরিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্র সৃষ্টির বৈচিত্র্যে নাটাসাহিত্যও ঐশ্বর্যে ও প্রাতিস্বিকতায় অনন্য। কাব্যের মতো তাঁর নাটকে রূপ-রূপান্তর লক্ষ করা যায়। বিষয় ও আঙ্গিকের রূপ-রূপান্তর তাঁর চেতনা দ্বারা অভিসিক্ত হয়েছে।

বাংলা নাটকের সূচনা: বাংলা নাটকের শুরু মূলত অনুবাদের মাধ্যমে। হেরোসিম স্তেপানোভিচ লেবেডেফ নামক একজন রুশ দেশীয় আগন্তক কলকাতায় বেঙ্গল থিয়েটার নামে একটি রঙ্গালয় স্থাপন করেন। তিনি The Disguise এবং Love is the best Doctor, নামে দুখানি নাটক বাংলায় ভাষান্তরিত করে এদেশীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা অভিনয় করান। ১৭৯৫ সালে বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয় হয়।

মৌলিক নাটকের সূত্রপাত: ১৮৫২ সালে বাংলা মৌলিক নাটক রচনার সূত্রপাত হয়। তারাচরণ শিকদারের ডদ্রার্জুন এবং যোগেন্দ্র চন্দ্র গুপ্তের কীর্তিবিলাস এ সময় বাংলা মৌলিক নাটক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলা নাটকের ইতিহাসে অস্থিরচিত্ততা কাটিয়ে রামনারায়ণ তর্করত্ন উল্লেখযোগ্য নাটক সৃষ্টি করেন। তার বিখ্যাত নাটক হলো কুলীনকুল সর্বস্ব। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৫৯ সালে শর্মিষ্ঠা নামে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক নাটক সৃষ্টি করেন যা বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রাণ সঞ্চার করে।

বাংলা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদানঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারায়  গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কারণ তার আগে নাটকে বাহ্যিক ক্রিয়া ও সংঘর্ষের প্রাধান্য ছিল, তিনি তা বর্জন করে হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে সচেষ্ট হন। তিনি নাটকে যে সূক্ষ্ম কলাকৌশল ও গভীর আত্মজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের মঞ্চের সাথে যোগাযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। তিনি সব সময় অভিনয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার নাট্য রচনার মাধ্যমে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদর্শন নাটকেও রূপায়িত করেছেন। এদিক থেকে সাংকেতিক নাটকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলের মাধ্যমে তিনি নিজ আদর্শবাদ এবং ধর্মনির্ভর জীবনতত্ত্ব তুলে ধরেছেন।

নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে ভাষা সৃষ্টিতে। তার ভাষার বৈশিষ্ট্যের জন্য নাটকগুলো গতিশীল ও আবেগপ্রধান। তিনি পরিমিত ও সংক্ষিপ্ত সংলাপ ব্যবহার করেছেন। তিনি বিভিন্ন রকমের নাটক রচনা করেছেন। তার নাটককে কবিতার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

গীতিনাট্য : রবীন্দ্রনাথের কৈশোর-যৌবনে অনেক লেখা গীতিনাট্যে প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে লিরিক আবেগ এবং নাটকীয় ঘটনার বিকাশ এক ধরনের বিচিত্র রস সৃষ্টি করেছিল। গীতিনাট্য হিসেবে কালমৃগয়া, মায়ার খেলা, বাল্মীকি প্রতিভা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নাট্যকাব্য: বিশেষ কতকগুলো নাট্য রচনায় নাট্যধর্মের চেয়ে কাব্যধর্ম বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে তা নাট্যকাব্য নামে পরিচিত । এ শ্রেণির নাট্যকাব্য সৃষ্টি হচ্ছে বিদায় অভিশাপ।

কাব্যনাট্য: রবীন্দ্রনাথ গীতিনাট্য রচনার প্রেক্ষাপটেই ‘রুদ্রচণ্ড’ প্রকৃতির প্রতিশোধ প্রভৃতি কাব্যনাট্য রচনা করেন। সেদিক থেকে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রতিভা কখনো সংগীত কখনো কাব্যাশ্রিত ছিল। ‘বিসর্জন’ ‘রাজা ও রানী’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রভৃতি তার কাব্যনাট্য।

সামাজিক নাটক: রবীন্দ্রনাথ সাংকেতিক নাটক রচনায় অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। তার আগে বাংলা সাহিত্যে সাংকেতিক নাটক ছিল না। প্রমথনাথ বিশী এ শ্রেণির নাটককে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ১. মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক, ২. মানুষের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক, ৩. মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। এ ধরনের সাংকেতিক নাটকের। মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজা, ডাকঘর, কালের যাত্রা, তাসের দেশ ইত্যাদি।

প্রহসন: বাংলা সাহিত্যে প্রহসন রচনায় রবীন্দ্রনাথের অবদান অতুলনীয়। তার হাস্যরসে একটি সুসংহত পরিমিতিবোধ এবং অন্তঃশায়ী সুগূঢ় রসের ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়। তার প্রহসনগুলো হচ্ছে বৈকুণ্ঠের খাতা, চিরকুমার সভা, শেষরক্ষা ইত্যাদি।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন। নাট্যসাহিত্যের সব শাখাতেই তার অবদান রয়েছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এক বিশেষ সফলতার দাবিদার।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।

Rate this post