তালাক(Talaq) কি? মুসলিম আইনে বিভিন্ন তালাকের প্রকারভেদ আলোচনা করুন।


ইসলামি শরিয়ত আইন অনুযায়ী বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক দায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যখন তাদের মধ্যে এই দায় ও অধিকারের ঘাটতি দেখা দেয় তখন যে কেউ বিবাহবিচ্ছেদের মতো  সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিবাহ-বিচ্ছেদের (Dissolution of marriage) যেসকল পদ্ধতি রয়েছে তাদের মধ্যে তালাক (Talaq) একটি অন্যতম পদ্ধতি।


তালাক (Talaq) শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ “Divorce” অর্থ  ‘বিবাহচ্ছেদ’, ত্যাগ করা, ফরাকত ইত্যাদি। ইসলাম ধর্ম মতে  আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদের নামই তালাক। বিধান অনুযায়ী তালাক বলতে স্বামী কর্তৃক তার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে বা স্ত্রী কর্তৃক আদালত হতে প্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় ডিক্রী দ্বারা বিবাহ-বিচ্ছেদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক কোন সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন মুসলিম পুরুষ কোনরূপ কারণ দর্শানো ছাড়াই স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী তার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই তালাক উচ্চারণ করতে হবে। আবার খেয়াল রাখতে হবে যে, স্বামী এবং স্ত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ পৃথক আছেন কেবল এই ঘটনা হতে কোন তালাক অনুমান করা যাবে না। কোন নাবালক কিংবা তার অভিভাবক তার পক্ষে নাবালকের স্ত্রীর ওপর তালাক উচ্চারণ করতে পারে না। একজন পাগল তার সাময়িক ভাল অবস্থায় তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে কিন্তু সে তার পাগলামী চলাবস্থায় তালাক দিতে পারে না । তালাক উচ্চারণ এবং তা কার্যকর হওয়ার জন্য স্ত্রীর উপস্থিতি অপরিহার্য নয়। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তালাক বৈধ হবে। 


Abdul Khader v. Aziza Bee, A.I.R. 1944 Madras 227 মামলার রায়ে বলা হয় যে, স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে উচ্চারিত তালাক বৈধ ও কার্যকর হবে, তবে তালাকের সংবাদ স্ত্রীকে জানাতে হবে। তালাকের সংবাদ স্ত্রীর নিকট স্বামী না পৌঁছালেও তালাক প্রদানের সময় থেকে তালাক কার্যকর হবে।


১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে, যেকোন আকারে তালাক প্রদান করা হোক না কেন, তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ দেয়ার ৯০ দিন পর কার্যকর হবে। যদি চেয়ারম্যানকে কোন নোটিশ দেয়া না হয়, তবে তালাক কার্যকরী হবে না। কারণ মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭(৩) ধারা অনুসারে নোটিশের তারিখ থেকে মেয়াদ হিসাব করা হবে। এই নোটিশের অনুলিপি স্ত্রীকে প্রদান করা স্বামীর ওপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি স্বামী তার স্ত্রীকে নোটিশের অনুলিপি না দেয়, তবে তিনি ৭(২) ধারার অধীনে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। চেয়ারম্যান নোটিশ পাওয়ার পর নব্বই দিনের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং তাদের মধ্যে সমঝোতা আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিবেন। তবে তালাক উচ্চারণকালে স্ত্রী গর্ভবতী হলে নব্বই দিন বা গর্ভাবস্থা যেটা পরে ঘটবে ততদিন পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। তবে স্বামী যদি নব্বই দিনের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার করে নেয় তবে তালাক কার্যকর হবে না।

Ali Newaz Gardezi vs. Md. Yusuf (1963) 15 DLR SC; মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়, চেয়ারম্যানকে নোটিশ না দেয়ার অর্থ হচ্ছে স্বামী তার ঘোষিত তালাক প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং এটা তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষে সুবিধাজনক হিসেবে বিবেচিত হবে। 


তালাকের প্রকারভেদ (Forms of talaq)

তালাক প্রধানত দুই প্রকার-

১। সুন্নাহ পদ্ধতির তালাক বা তালাক-আল-রাজ (Talaq-al-Sunna or Talaq al-rajee)

  • তালাক-ই-আহসান (Talaq-e-Ahsan);
  • তালাক-ই-হাসান (Talaq e-Hasan)।

২। তালাক-উল-বিদাত বা অননুমোদিত তালাক (Talaq ul- Bida/Takaq-ul-biddat)


১। সুন্নাহ পদ্ধতির তালাক বা তালাক-আল-রাজ (Talaq-al-Raj)

এই পদ্ধতির তালাককে তালাকে “রাজি” বা প্রত্যাহারযোগ্য তালাক বলা হয় যা ইদ্দতের মধ্যে যেকোন সময় স্বামী প্রত্যাহার করতে পারে। এই প্রকার তালাককে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে-

ক। তালাক-ই-আহসান (Talaq – e-Ahsan)

এই পদ্ধতিতে তালাকের ক্ষেত্রে ঋতুবর্তী স্ত্রীর দুই ঋতু মধ্যবর্তী পবিত্র (তুহুর) অবস্থায় স্বামী স্ত্রীকে একবার মাত্র তালাক উচ্চারণ করবে এবং স্ত্রীর ইদ্দতকালে (তিনটি ঋতুকাল পর্যন্ত) তার সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে না। এমতাবস্থায় ইদ্দতকাল শেষ হবার সাথে সাথেই তালাক অখন্ডনীয় হবে এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ সংঘটিত হবে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এই পদ্ধতির তালাককে অনুমোদন করেছিলেন। এই প্রকারের তালাক সর্বাপেক্ষা অনুমোদিত তালাক, কেননা এতে একবারই তালাক উচ্চারিত হয় এবং স্বামী ইদ্দত চলাকালীন যেকোন সময়ে তালাক প্রত্যাহার করে স্ত্রীকে ফেরত নিতে পারেন।

খ। তালাক-ই-হাসান (Talaq-e-Hasan)

এই প্রকার তালাক প্রদানের পদ্ধতি হলো, স্বামী তার স্ত্রীর পর পর তিনটি তুহরের প্রত্যেক তুহরেই একবার করে তালাক উচ্চারণ করবে এবং তুহরকালে স্ত্রীর সাথে যৌন সহবাস থেকে বিরত থাকবে। তৃতীয় উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তালাক কার্যকর হবে। এই তালাক অপ্রত্যাহারযোগ্য। স্বামী তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণের পূর্বে যেকোন সময় স্ত্রীর সাথে যৌন সহবাস বা ঘোষণা দিয়ে বা আচরণের দ্বারা তালাক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।

২। তালাক-উল-বিদাত বা অননুমোদিত তালাক (Talaq ul- Bida/Takaq-ul-biddat)

তালাক-ই-আহসান ও তালাক-ই-হাসান পদ্ধতি ছাড়া অন্য সকল পদ্ধতির তালাককে তালাক-উল-বিদাত বলা হয়। স্বামী পর পর তিন তালাক উচ্চারণ করে অথবা এক বাক্যে তিন তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় অথবা অপবিত্র অবস্থায় এই তালাক প্রদান করা হয়।

যেমন স্ত্রীর পবিত্র বা অপবিত্র অবস্থায় স্বামী স্ত্রীকে বলে, “আমি তোমাকে তালাক দিলাম, তালাক দিলাম, তালাক দিলাম” অথবা “আমি তোমাকে তিন তালাক দিলাম” অথবা “আমি তোমাকে বাইন তালাক দিলাম” ইত্যাদি। এই ধরনের তালাক প্রত্যাহার করা যায় না। ইসলাম এই ধরণের তালাককে নিকৃষ্ট আখ্যায়িত করে এই তালাকের অনুমোদন দেয়নি।

খসড়া

Rate this post