প্রশ্নঃ অস্টিনের আদেশাত্মক তত্ত্ব ও কেলসেনের আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্বের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা কর। এই দুই তত্ত্বের সাথে আইনের প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কর।

উত্তরঃ অস্টিনের আদেশাত্মক তত্ত্ব (Austin’s imperative theory) এবং কেলসেনের আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব (Kelsen’s pure theory of law) এবং এদের সাথে আইনের প্রকৃতিবাদীদের (Naturalist) সম্পর্কঃ 

প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিজ্ঞানী জন অস্টিন কর্তৃক প্রদত্ত আদেশাত্মক তত্ত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যদিও তার গুরু জেরেমি বেনথামই প্রকৃত অর্থে এই মতবাদের আদি প্রবক্তা। অস্টিনকে ইংল্যান্ডের আইনবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। অস্টিনের মতে, পজিটিভ ল-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য মূলত ৩টি। এগুলি হচ্ছে- ১। ইহা এক ধরনের আদেশ, ২। এই আদেশ রাজনৈতিক সার্বভৌম কর্তৃক প্রদত্ত এবং ৩। এর লংঘন শাস্তিযোগ্য। 

সাধারণ উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের রোড ট্রাফিক এ্যাক্ট ১৯৬০-এর উল্লেখ করা যায়। এই আইনে কিছু বিধি-নিষেধ সন্নিবেশিত করা হয়েছে যাকে আদেশ বলা যায়। এই আইনটি পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে যাকে রাজনৈতিক সার্বভৌম বলা যায়। এটা লংঘন করলে শাস্তি প্রদান করা হয় এবং এভাবে তা বলবৎযোগ্য থাকে যাকে আইনের পরিভাষায় Sanction বলা হয়।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হ্যানস কেলসন আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন ১৯১১ সালে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র ইউরোপে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

তার তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে নর্মস (Norms)। ‘নমস’ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রস (Ross) বলেন যে, নমস হচ্ছে সামাজিক ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখানোর দিক নির্দেশনা বিশেষ। আইনের নর্মসকে আচরণের নর্মস এবং পদ্ধতির নর্মস এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। তাই এক কথায় নর্মসকে বিধি বলা যায়। 

কেলসনের মতে, এই বিধি বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে একে আচরণবিধিভিত্তিক বিজ্ঞান (normative science) বলা যায় যা হচ্ছে আইন। কেলসন অস্টিনের তত্ত্বকে বাতিল করেননি বরং তাকে অনেক ক্ষেত্রেই সমর্থন করেছেন। তাই উভয়কেই পজিটিভ ল বা দৃষ্টিবাদী আইনের প্রবক্তা বলা হয়। কিন্তু অস্টিনের আদেশতত্ত্বকে কেলসন গ্রহণ করেন না। তার মতে, ন্যায়বিচার সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত চিন্তা- ভাবনা বা প্রাকৃতিক আইনের মতবাদ দ্বারা আইনকে অধিবিদ্যামূলক কুয়াশাচ্ছন্ন দ্বারা আবৃত্ত রাখা হয়েছে। তিনি এর থেকে আইনকে উদ্ধার করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি বাদ দিয়ে এবং অন্যান্য সামাজিকবিজ্ঞান হতে একে পৃথক করে বিশুদ্ধ আইন বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তাই কেলসনের তত্ত্বকে Pure Theory of Law বা আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব বলা হয়।

আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উভয় তত্ত্বে বলপ্রয়োগের বিধান লক্ষ্য করা যায়। স্বেচ্ছায় মানুষ আইন মান্য করে তা বলা যায় না বরং এটা অমান্য করলে যে পরিণতি হতে পারে তার ভয়েই জনগণ আইন মেনে চলে। 

মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, বিচার-অবিচার, সাধুতা-অসাধুতা, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি বুঝতে পারে এবং এগুলির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। প্রকৃতি প্রদত্ত অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক এরূপ সহজাত গুণাবলী শুধু মানুষেরই আছে অন্য কোন সৃষ্ট জীবের নেই। প্রকৃতিগত এরূপ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার যে সকল নীতি গড়ে উঠেছে তাকেই প্রাকৃতিক আইন বলে। অস্টিন ও কেলসন উভয়েই প্রকৃতিবাদীদের এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেন না। তাদের মতে, এগুলি অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। তবে কেলসন অস্টিনের তুলনায় প্রাকৃতিক আইন গ্রহণের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। 

অস্টিনের আদেশমূলক তত্ত্ব এবং কেলসনের বিশুদ্ধ আইনতত্ত্ব উভয়েই দৃষ্টবাদী আইন বা পজিটিভ ল সমর্থন করেন যা মানুষ তৈরি করেছে এবং রাষ্ট্রীয় শক্তি দ্বারা এ আইন বলবৎ করা হয়। তবে এটাও ঠিক যে, রাষ্ট্র নিজ খেয়ালখুশীমত আইন তৈরি করতে পারে না, সামাজিক প্রয়োজন ও জনগণের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করতে হয় যা প্রাকৃতিক আইনের উপাদান। কোন আইন অযৌক্তিক মনে হলে জনগণ তা বর্জন করতে পারে এবং বিদ্রোহ করতে পারে। দেশে যদি এরূপ আইন প্রণয়ন করা হয়। 

রুগ্ন, বিকলাঙ্গ বৃদ্ধরা অথর্ব ব্যক্তিদের সমাজ হতে নিশ্চিহ্ন করা হবে তাহলে নিশ্চয়ই সে আইন সমাজ প্রত্যাখ্যান করবে । এগুলি প্রাকৃতিক আইনের বৈশিষ্ট্য।

দৃষ্টিবাদীরা যদিও প্রকৃতিবাদীদের সমর্থন করেন না তবুও দেখা যায় যে, প্রাকৃতিক আইনের নীতির পরিপন্থী কোন আইন সমাজে সমাদৃত হয় না। তাই প্রকারান্তরে অস্টিন ও কেলসন কর্তৃক দৃষ্টবাদ আইনও প্রাকৃতিক আইনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই আন্তর্জাতিক আইনের জনক গ্রোসিয়াস শ্লেষাত্মকভাবে মানুষের প্রকৃতিকে প্রপিতা, প্রাকৃতিক আইনকে পিতা এবং দৃষ্টবাদ আইনকে পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

কেলসনের মতে, যেভাবে আইন রয়েছে তাকে ভিত্তি করেই আইনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, কিরূপ আইন হওয়া উচিত তার উপর ভিত্তি করে নয়। তিনি অবশ্য আইনগত উচিত এবং অন্যান্য ঔচিত্য এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন যে, আইনগত ঔচিত্যের ক্ষেত্রে শক্তির সমর্থন থাকে যা অন্যান্য ক্ষেত্রে থাকে না। এ বিষয়ে অস্টিন ও কেলসন ঐকমত্য পোষণ করেন যদিও এর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তারা ভিন্নমত পোষণ করেন। 

কেলসন বলেন যে, আইন বহির্ভূত কোন ঘটনা হতে আইনগত উদ্ভব হয় না। অস্টিন বলেন যে, কোন ব্যক্তি চুরি করলে আইন অনুযায়ী তার সাজা হবে এবং এটাই হচ্ছে স্যাংশন। কিন্তু কেলসন বলেন যে, স্যাংশনের প্রয়োগ নির্ভর করে আইনের অন্যান্য বিধিসমূহের উপর। এক বিধিবলে চুরি করলে তাকে প্রেপ্তার করতে হবে। অন্য বিধিবলে তাকে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করতে হবে। বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দিতে হবে যা আরেক বিধির আওতাভুক্ত। এছাড়া অন্য এজেন্সি দ্বারা তার শাস্তি কার্যকর করতে হবে অন্য বিধির আওতায়। কাজেই কেলসনের মতে, স্যাংশন অনেক বিধির সমন্বয়ে গঠিত।

কেলসনের মতে, প্রত্যেক আইনগত কার্য একটা নর্ম বা আচরণবিধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই নর্মসগুলি ক্রম অধিকার বিন্যাসিত অর্থাৎ নিম্নতম হতে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত ক্রম বিভক্ত কর্তৃত্বের ভিত্তিতে সংগঠিত। যে নর্ম বা ঔচিত্যকে ভিত্তি করে অন্যান্য নর্মস গড়ে উঠেছে তাকে কেলসন Grundnorm বা মৌলিক নর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইংল্যান্ডে ক্রাউন ইন পার্লামেন্ট হচ্ছে এরূপ একটা গ্রান্ডনর্ম যা সেখানে এমনই কার্যকর যে, ইহা যে কোন আইন তৈরি বা বাতিল করতে পারে। একে কেন্দ্র করেই অন্যান্য আইনগত নর্ম গড়ে উঠেছে। যেমন চুরি করলে শাস্তি দেয়া হয়। এই শাস্তি দেয়ার বৈধতা আসছে বিচারিক সিদ্ধান্ত হতে এবং বিচারক ক্ষমতা পায় বিভিন্ন বিধি ও আইনের মাধ্যমে। সর্বোপরি এই আইনগুলির বৈধতা নিরূপিত হচ্ছে পার্লামেন্টের কার্য দ্বারা। কাজেই প্রত্যেক নর্মের পেছনে আরেকটি নর্ম থাকে যার থেকে এটা বৈধতা পায় এবং সকলের পেছনে যে মূল নর্ম থাকে সেটাই হচ্ছে গ্রান্ডনর্ম। সকল দেশে একই গ্রান্ডনর্ম থাকে না, বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু কেলসনের মতে, গ্রান্ডনর্ম অবশ্যই থাকবে।

আইনের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে সমাজের মঙ্গল সাধন করা। কাজেই কর্তব্যবোধ হচ্ছে আইনের সারবস্তু। প্রকৃতিবাদীদের মতে মানুষের ঔচিত্যবোধ এই কর্তব্য কর্মে প্রবৃত্ত করে কিন্তু অস্টিন ও কেলসনের দৃষ্টবাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রীয় শক্তি মানুষকে কর্তব্য করতে বাধ্য করে। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ কর্তব্য পালন করলে অন্যের অধিকার আপনা আপনি প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই সামাজিক শান্তিও নিশ্চিত হয়।

Rate this post