প্রশ্নঃ দেওয়ানী ন্যায়বিচার ও প্রশাসন ফৌজদারী ন্যায়বিচার প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য কর। তোমার মতে বাংলাদেশে উভয় প্রকার বিচার প্রশাসনের প্রধান দুর্বলতাসমূহ কি?

উত্তরঃ দেওয়ানি বিচার ও ফৌজদারি বিচারের মধ্যে পার্থক্য কীঃ দেওয়ানী বিচার ও ফৌজদারী বিচারের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপঃ

(১) ব্যক্তিগত অধিকার কিংবা আইনগত স্বত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে দেওয়ানী বিচারের মাধ্যমে অধিকার পুনর্বহাল করা হয়। অপরদিকে, গণ-অধিকার ক্ষুণ্ণ করে সামাজিক শান্তি- শৃঙ্খলা বিঘ্ন করা হলে কিংবা ফৌজদারী দণ্ডবিধিতে বর্ণিত অপরাধগুলি সংঘটিত করলে ফৌজদারী বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

(২) দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা দেওয়ানী কার্যবিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়। কিন্তু, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা ফৌজদারী কার্যবিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়।

(৩) দেওয়ানী বিচার দ্বারা কেবল ব্যক্তি বিশেষের অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। অপরপক্ষে, ফৌজদারী বিচার দ্বারা ব্যক্তি সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় অর্থাৎ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় ৷

(৪) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে অধিকার বলবৎকরণ, সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন, নিষেধাজ্ঞা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দ্বারা প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। পক্ষান্তরে, ফৌজদারী বিচারে অপরাধের প্রকৃতি ও গুরুত্ব অনুসারে কারাদণ্ড, জরিমানা, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি ধরনের শান্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকার দেয়া হয়।

(৫) দেওয়ানী বিচার দেওয়ানী আদালতে সম্পন্ন হয়। ফৌজদারী বিচার কেবলমাত্র ফৌজদারী আদালতে সম্পন্ন হয়।

(৬) দেওয়ানী আদালতের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতের নাম মুন্সেফ আদালত বা সহকারী জজ আদালত। মামলা আনয়নকারীকে বাদী ও বিরুদ্ধ পক্ষকে বিবাদী বা প্রতিপক্ষ বলে। ফৌজদারী আদালতের সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতের নাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। মামলা আনয়নকারী পক্ষকে বাদী পক্ষ বা অভিযোগকারী এবং অপর পক্ষকে আসামী বলে।

(৭) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ স্বয়ং মামলা দায়ের করে। ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে সরকার বা ক্ষেত্র বিশেষে স্বয়ং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ মামলা দায়ের করে।

(৮) দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে বাদীকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয় না, কিন্তু ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকেও সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়।

(৯) দেওয়ানী বিচারে বাদীকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিবাদীকে তার দাবী প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু ফৌজদারী বিচারে একমাত্র বাদীকে প্রমাণের ভার বহন করতে হয়।

(১০) দেওয়ানী বিচারে বাদীকে তার দাবী প্রতিষ্ঠিত জন্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের কোন আবশ্যকতা নেই, কিন্তু ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে আসামীকে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বাদীপক্ষকে তার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামান্য সন্দেহের অবকাশ থাকলে আসামীকে শাস্তি দেয়া যায় না।

এভাবে দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়।

দেওয়ানী বিচার প্রশাসনের দূর্বলতাঃ দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থায় বাদীর উদ্যোগ ও দক্ষতা বেশী প্রয়োজন। গ্রাম বাংলার অধিকাংশ লোকই এ বিষয় অদক্ষ বা পর্যাপ্ত শিক্ষিত নয়। সে সুযোগে কিছু সংখ্যক টাউট তাদের শোষণ করে। এ সকল টাউটগণ তাদের পছন্দমত আইনজীবীদের নিকট এদেরকে নিয়ে যায় এবং আইনজীবীগণ এদের নিকট হতে দলিলপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নেয় এবং দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকে। অনেক অসাধু আইনজীবী এ সকল বিচার প্রার্থীদেরকে নানাভাবে শোষণ করতে থাকে। আদালতও তাদের ইঙ্গিতে বছরের পর বছর মামলাগুলি ঝুলিয়ে রাখে। এছাড়া বিচার পদ্ধতিও বেশ জটিল। দীর্ঘ সূত্রিতা দেওয়ানী বিচার প্রশাসনের মূল দূর্বলতা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আদালতের ডিক্রী পেলেও তা বাস্তবায়নের জন্য আবার ডিক্রী কার্যকরণের মামলা করতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিবাদী নালিশী সম্পত্তির অনেক ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিচার পদ্ধতি সহজ করা প্রয়োজন। বিচারকের সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে হবে। কমিশনের মাধ্যমে নালিশী সম্পত্তি সরেজমীনে পরিদর্শন ও ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমাণের বিড়ম্বনা হতে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কেননা আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে অনেক ব্যক্তি অনীহা প্রকাশ করে। দরিদ্র ব্যক্তিরা রাজী হয় বটে। কিন্তু তার বিনিময়ে অর্থ দাবী করে। তাই প্রকৃত সাক্ষীদেরকে আদালতে নিয়ে যাওয়া বাদীর জন্য অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে পড়ে। কমিশনের মাধ্যমে পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করলে এটা অনেক সহজ হয়। এছাড়া এ.ডি.আর বা বিকল্প বিবাদ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে আপোস বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে দেওয়ানী বিচার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এবং অল্প খরচের মধ্যে তা সম্পন্ন করা যায় । এছাড়া বিবদমান পক্ষগণের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

ফৌজদারী বিচার প্রশাসনের দূর্বলতাঃ ফৌজদারী বিচার প্রশাসনের ক্ষেত্রে নালিশী মামলা ছাড়া অন্যান্য মামলায় পুলিশের ভূমিকা বেশী থাকে। আই. ও বা তদন্তকারী কর্মকর্তার সদিচ্ছা ও তৎপরতার উপর এরূপ বিচারের পরিণতি অনেকটা নির্ভর করে। সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসাটা অযথা বিড়ম্বনা বা হয়রানী মনে করে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই শুধু সাক্ষ্যের অভাবে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হয় না বরং বিচার প্রার্থী ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়। পুলিশের নিকট ১৬১ ধারায় প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য।

তাই ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রদত্ত বক্তব্য আর পুলিশের নিকট বক্তব্য এক না হলে আড়ালে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসামীর উপর পুলিশ অত্যাচার চালায়। এ অত্যাচারে কোন কোন সময় অপরাধ না করেও অপরাধ স্বীকার করে শুধু অত্যাচার থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণ পাবার জন্য। এরূপ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। একবিংশ শতাব্দীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতিতে প্রকৃত অপরাধীতে ধরা খুব কঠিন নয়। এজন্য পদ্ধতিগত আইনকে সংশোধন করে যুগোপযোগী করতে হবে।

Rate this post