অধ্যাপক ফিফার এবং প্রেসথাস (Pififfner and Presthus)-এর মতে, “The concept of unity of command requires that every member of an organization should report to one, and only one leader.” অর্থাৎ আদেশগত ঐক্যের ধারণা বিধান করে যে, সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যই একজন এবং কেবল একজন নেতার নিকট রিপোর্ট প্রদান করবেন। [১৮. John M. Pfiffner and R. V. Presthus, public Administration, p. 31.]

যে কোন সংগঠনে আদেশের ঐক্য থাকা একান্ত আবশ্যক। যখন সংগঠনের সকল পর্যায়েই ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মচারীর মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিদ্যমান থাকে, তখন সেখানে দায়িত্বের ব্যাপারে কোন বিভ্রান্তি দেখা দেয় না। সংগঠনে কার্যরত প্রত্যেক ব্যক্তিই, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কে এবং তিনি কার নির্দেশ পালন করবেন, তা সহজেই বুঝতে পারেন। কিন্তু যদি তাকে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট হতে পরস্পর বিরোধী নির্দেশ লাভ করতে হয়, তাহলে তিনি কার নির্দেশ পালন করবেন, সে ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে এবং তার পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অধস্তন কর্মচারীগণ বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের নিকট হতে বিভিন্নরূপ আদেশ লাভ করলে, তারা নিজেদের সুবিধার স্বার্থে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অপরজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিবে। এ সবকিছুরই পরিণতিস্বরূপ নিজ নিজ দায়িত্ব আর স্পষ্ট থাকবে না এবং সে ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা দিবে। সামরিক বাহিনীর সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে ‘আদেশগত ঐক্য’-এর নীতি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হয়৷

আদেশগত ঐক্য (Unity of command)-এ নীতি অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে, কোন সংগঠনের কোন সদস্যকে এমন কোন পদমর্যাদা দেয়া উচিত হবে না, যেখানে তিনি একাধিক ঊর্ধ্বতনের কাছ থেকে নির্দেশ পাবেন। আদেশের ঐক্য পদবাচ্যটিকে নিম্নোক্ত তিনভাগে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ

১। এর অর্থ হলো, সংগঠনের সকল শাখা একজন প্রধানের মাত্র কর্তৃত্বাধীনে সংবদ্ধ করতে হবে। প্রধান ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট বা সচিব বা কর্মকর্তামণ্ডলী হতে পারে।

২। এর অর্থ হলো, কোন সংগঠনের শীর্ষস্থানে একজন মাত্র ব্যক্তি থাকা বাঞ্ছনীয় ব্যক্তিমণ্ডলীকে শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত করা কাম্য নয়। কর্তৃত্বের সকল ধারা বা লাইন তার হাতে ন্যস্ত করা উচিত। এ ব্যাখ্যা অনেকটা সামাজিক সাংগঠনিক তত্ত্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে আদেশের লাইনের মাধ্যমে সকল যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। বেসামরিক প্রশাসনে এর তুল্য ব্যাপারটি হলো “Through proper channel” বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে।

৩। এর অর্থ হলো, কোন কর্মচারী তার নিকটস্থ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে আদেশ পাবেন না। তিনি একজন মাত্র ঊর্ধ্বতনের আদেশ লাভ করবেন।

উপরের তিনটি ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তৃতীয় ব্যাখ্যাটি কমবেশি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত হয়েছে। অন্য দু’টি ব্যাখ্যায় ‘আদেশের ঐক্য’ পুরোপুরি বিম্বিত হয় নি। আমরা যদি (১)- ব্যাখ্যাটির আলোকেই আদেশের ঐক্য বুঝতে যাই তবে ভুল হবে। কারণ ‘স্বতন্ত্র নিয়ামক কমিশন ‘সরকারি করপোরেশন’ ইত্যাদির মত স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত ইউনিটগুলোর অস্তিত্ব উক্ত সূত্রের সাথে খাপ খায় না। আমরা যদি (২)-ব্যাখ্যাটির কথা ধরি, তাহলেও বোর্ড বা কমিশন ধরনের সংগঠনের যেমনঃ ‘পল্লী উন্নয়ন বোর্ড’ বা ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশনের’ মত সংগঠন ব্যাখ্যা আমরা তাতে পাই না।

তাহলে আদেশের ঐক্য কথাটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে- প্রত্যেক কর্মচারীর একজন মাত্র বস (Boss ) বা কর্মকর্তা থাকবেন। কেবল তার কাছ থেকেই কর্মচারীটি আদেশ লাভ করবেন। কর্মচারীটি একাধিক অফিসারের কাছ থেকে আদেশ লাভ করলে তার দায়িত্ব সম্পাদন অসম্ভব না হলেও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ঊর্ধ্বতনের কাছ থেকে তিনি যদি পরস্পর-বিরোধী আদেশ লাভ করেন, তবে কর্মচারীটির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়বে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এতে সমস্যায় পড়বেন। কারণ, কর্মচারীটি তাদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারে। এর ফলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে বাধ্য। কর্তৃত্ব কোথায় নিহিত তা সঠিকভাবে জানতে পারলে একমাত্র তখনই আমরা দায়িত্ব কার তা শনাক্ত করতে পারি। কর্তৃত্ব যদি বিভাজিত হয়ে পড়ে তবে দায়িত্ব শনাক্ত করা দুষ্কর। 

লুথার গুলিক (Luther Gulick) বলেছেন, “সমন্বয় ও সংগঠনের ক্ষেত্রে এ নীতিগুলো তাৎপর্য সম্পর্কে উদাসীন হলে চলে না। সমন্বয়ের কাঠামো ও বিন্যাস বিরচনকালে যে কাজের একাধিক সম্পর্কসূত্র রয়েছে সে কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তির উপর একাধিক কর্তা চাপিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রায়শই দেখা দেয়। ‘আদেশের ঐক্য’ নীতি অনড়ভাবে অনুসরণ করলে অবাস্তবর্তী জন্ম দিতে পারে। তবে নীতিসূত্রটি লঙ্ঘন করলে যে বিভ্রান্তি, অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার উদ্রেক ঘটে, সে তুলনায় ঐ অবাস্তবতা (Absurdities) অনেক সামান্য।”

যদিও আদেশগত ঐক্য নীতির গুরুত্ব তত্ত্বগত দিক হতে অখণ্ডনীয়, তথাপি বাস্তবে এ নীতির যথেষ্ট ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। একজন ব্যক্তি কর্মচারী সচরাচর দ্বৈত আদেশ বা নিয়ন্ত্রণের অধীনস্থ হয়ে থাকেন- একটি হচ্ছে প্রশাসনিক (Administrative) এবং অপরটি হচ্ছে কারিগরি বা পেশাগত (Technical of Professional)। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য বিভাগের একজন মেডিকেল অফিসার-এর কথা ধরা যাক। প্রশাসনিক দিক হতে তিনি স্থানীয় সংস্থার সভাপতির অধীনস্থ কিন্তু পেশাগত দিক হতে তিনি জনস্বাস্থ্য পরিচালকের অধীনস্থ। 

অধ্যাপক জন ডি. মিলেট (John D. Millet) যথার্থই বলেছেন যে, “The concept of unity of command needs to be reconciled with a recognition that supervision of any activity may be dual technical and also administration.” অর্থাৎ যে কোন কর্মের তত্ত্বাবধান দুই ধরনের হতে পারে, অর্থাৎ একে টেকনিক্যাল এবং প্রশাসনিক দিক দিয়ে তত্ত্বাবধান করা যায়। আর এ কথা স্বীকার করে নিবার মাধ্যমে আদেশগত ঐক্যের ধারণাকে সমন্বিত করা আবশ্যক। [Quoted in F. M. Marx, Elements of public Administration, p. 150.] 

আবার অধ্যাপক হার্বাট এ. সাইমনও (Herbert A. Simon) দ্বৈত তত্ত্বাবধানের নীতিকে সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন যে, “যেখানে দু’টি কর্তৃত্বপূর্ণ নির্দেশের মধ্যে বিরোধ দৃষ্ট হয় সেখানে এমন একজন সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা থাকা উচিত যার নির্দেশ অধস্তন ব্যক্তি পালন করবে; আর ঐ একক কর্মকর্তার প্রতি তাকে অনুগত রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করা উচিত।”

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক এফ. ডব্লিউ. টেলর (F. W. Taylor)-ও আদেশগত ঐক্যের নীতিকে অস্বীকার করেছেন এবং পক্ষান্তরে দ্বৈত তত্ত্বাবধানের নীতি ও নিয়ন্ত্রণের প্রতি সমর্থন দান করেন। টেলর আদেশগত ঐক্যকে ‘সেনাবাহিনী প্রকৃতির ফোরম্যানশীপ’ (Military type of Foremanship) বলে বর্ণনা করেছেন এবং এর পরিবর্তে ‘কার্যক্রমগত ফোরম্যানশীপের’ (Functional Foremanship) কথা বলেছেন। এ কার্যক্রমগত পদ্ধতির প্রধান সুবিধা হচ্ছে প্রতিটি কর্মের সুদক্ষ তদারকি। এভাবে এটি শ্রম বিভাগের (Division of Labor) পথ উন্মুক্ত – করে। টেলর (Taylor)-এর এ ধরনের কর্মদক্ষতার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারণার বিকাশ এবং প্রসারের ফলে কোন কোন সমালোচক তাদের সপক্ষে যুক্তি দেখান যে, প্রশাসনিক সংগঠনের আদেশগত ঐক্য ভেঙ্গে পড়েছে।

তবে আদেশগত ঐক্য নীতির সমর্থকগণ এটাকে সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা হতে এ যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, লোক প্রশাসনের প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞগণ কোন প্রকার সত্যিকার স্বাধীন কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ঘটাতে পারেন না। তারা কেবল স্টাফ হিসেবে লাইন প্রধানকে উপদেশ প্রদান করে থাকেন। এ দিক হতে বিচার করলে দেখা যায় যে, সংগঠনে আদেশগত ঐক্য অমান্য করা হয় না। এমন কি প্রশাসনিক প্রধান টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের কার্যক্রম জানতে বা বুঝতেও সক্ষম হন না। অবশ্য আদেশগত ঐক্য নীতির সপক্ষে অধিকতর জোরালো যুক্তি হচ্ছে যখন কোন কর্মচারী একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট হতে তার অধীনস্থ বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ বা নির্দেশ লাভ করেন তখন এটার অবমাননা ঘটে না। এটা তখনই মান্য করা হয় না, যখন কোন কর্মচারী কোন নির্দিষ্ট এবং একই বিষয়ে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট হতে আদেশ বা নির্দেশ লাভ করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আদেশগত ঐক্য নীতি বৃহদায়তন প্রশাসনিক সংগঠনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সহায়কও বটে। তবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রের ন্যায় একে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না। তবে নির্দেশের ঐক্য (Unity of Direction), উদ্দেশ্যের একতা (Unity of Purpose), আদেশ ও নিয়ন্ত্রণের স্থিতিশীলতা (Stability of Command ar d Control) নিশ্চিতকরণে এ নীতির ভূমিকা ও গুরুত্ব অবশ্যম্ভাবী।

1/5 - (1 vote)