প্রশ্নঃ প্রতিকী মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, প্রতিকী মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা কর ।

ভূমিকাঃ আমরা প্রতিনিয়ত ব্যক্তিত্ব শব্দটির মুখোমুখি হই। প্রায়ই আমরা বলি, ‘অমুকের ব্যক্তিত্ব চমৎকার। এই বাক্য দ্বারা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির আচরণের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক রূপ। যেমন ব্যক্তির দোষ, গুণ, সামর্থ্য, চেহারা, বিশ্বাস, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, আবেগ ইত্যাদি। এককথায় ব্যক্তির সারসত্তাই হলো ব্যক্তিত্ব।

প্রতীকী মিথষ্ক্রিয়া (Symbolic Interaction): ষোলো শতকের শেষভাগে দার্শনিক জন লক তার “Human Understanding” গ্রন্থে শব্দ বা কথা, ব্যক্তি মানুষের মাঝে ঐসব শব্দের অন্তর্গত অর্থ ও মানুষে মানুষে বন্ধনের সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সম্পর্ক সমাজ গড়ে তোলে। তিনি বলেন, “ভাষা সমাজের এক মহান হাতিয়ার ও অভিন্ন সংযোগ সূত্র।” আঠারো শতকে ইমানুয়েল কান্টের মত লেখকেরা এই মর্মে ধারণা গড়ে তুলেন যে, পৃথিবী যে বাস্তব সত্যতায় অর্থাৎ চর্মচক্ষুতে যেভাবে বিরাজমান, মানুষ ঠিক ধারণায় নয় বরং তার মনোজগতে যে কল্প পৃথিবী গড়ে সেই পৃথিবীর প্রতিই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। 

চর্মচক্ষুর ‘বাস্তব পৃথিবী’ ও আমাদের ‘মানস পৃথিবীর’ মধ্যেকার এই পার্থক্যের বিষয়টি উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে জন ডিউয়ি ইউলিয়াম জেমস ও চার্লস পিয়ার্স এর মতো মার্কিন আশাবাদী লেখকদের লেখনীতে আরো পরিশীলিত, সূক্ষ্ম ও নিখুঁত হয়ে ওঠেছে। তাদের মতে, মানুষ যে পরিবেশ বাস করে সমষ্টিগতভাবে সেই পরিবেশেই নিজ নিজ ধ্যানধারণা গড়ে তোলে। এই লেখকদের অন্যতম মৌল ধারণা হচ্ছে বস্তুবিষয় বা পরিস্থিতির তাৎপর্য সেগুলোর বাস্তব প্রকৃতিতে নয়, বরং ঐগুলোর প্রতি মানুষের আচরণেই নিহিত।

যাদেরকে আধুনিক প্রতীকী মিথষ্ক্রিয়াবাদের বিশিষ্ট প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। তারা হলেন, সমাজতত্ত্ববিদ চার্লস হর্টন কুলী ও দার্শনিক জর্জ হার্বাট সীড। কুলী হচ্ছেন সেসব গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিতদের একজন যারা চিরকালের মতো প্রাচীন ‘প্রকৃতি লালন’ বিতর্কের অবসান ঘটান। মানুষ তার স্বভাব প্রকৃতি বংশগত সূত্রে পাওয়ার পরিবর্তে প্রয়াসের মধ্য দিয়ে অর্জন করে বলে যে ধারণ এখন প্রচলিত তিনি সেই ধারণার পক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও উল্লেখযোগ্য মতবাদ গড়ে তোলেন। সমাজজীবনের বিষয়মুখী প্রকৃতি ও সামাজিক আচরণের নির্দেশনা হিসেবে নিজেদের ও অন্যদের সম্পর্কে লোকে যে প্রক্রিয়ায় নানা বিশ্বাস বা ধারণা গড়ে তুলে সে সম্পর্কে তার ধ্যানধারণা মানবীয় আচরণের সহজাত সংজ্ঞার ভূমিকা সম্পর্কিত চিন্তাধারা বদলানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী। জর্জ হার্বাট সীড ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ভাষা প্রতীকসমূহের মৌল প্রকৃতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন।

প্রতিকী মিথস্ক্রিয়াবাদের সঠিক ধারণাগুলো কি হওয়া উচিত তার অনেকগুলো ভাষা জেরোমি কি মানিস ও বার্নার্ড এর মেলজার এর রচনাবলিতে পাওয়া যাবে। ব্যাপক সরলায়নের ঝুঁকি নিয়ে অবশ্য এই প্যারাডাইসের ধারণাগুলোকে এভাবে বর্ণনা করা যায়ঃ

(১) অর্থ-তাৎপর্যের সমাহার সংবলিত একটি ব্যবস্থা হিসেবেই সমাজকে দেখা সর্বোত্তম। ব্যক্তির জন্য এজমালি কতকগুলো ‘অর্থের’ অংশিদারীর বিষয়টি আন্তঃব্যক্তি তৎপরতা ছাড়া কিছুই নয় যে তৎপরতা থেকে স্থিতিশীল ও সাধারণভাবে বোধগম্য প্রত্যাশাসমূহের সৃষ্টি হয়। এসব প্রত্যাশা আচরণকে একটা পূর্ব অনুমানযোগ্য ছাঁচে গড়ে।

(২) আচরণগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে সামাজিক ও ভৌত-উভয় সত্যতাগুলোকে অর্থ-তাৎপর্যের নির্মাণ কাঠামো হিসেবে লেবেল দেয়া হয়। প্রতিকী মিথস্ক্রিয়ায় ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণের ফলশ্রুতি হিসেবে সভ্যতাসমূহের ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো যেমন সামাজিকভাবে রীতিবদ্ধ হয় তেমনি ব্যক্তি পর্যায়ে তা আত্মস্থও হয়ে যায়।

(৩) যে বাঁধনগুলো ঐক্যবদ্ধ করে, জনগণ অন্যদের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে সেগুলো প্রতিকী মিথষ্ক্রিয়া থেকে উদ্ভুত নানা অর্থের ব্যক্তিগত নির্মিতি বিশেষ; আর তাই জনগণ নিজেদের ও পরস্পরের সম্পর্কে যে বিষয়গুলো ধারণা বা বিশ্বাস পোষণ করে তা সমাজজীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।

(৪) একটা প্রদত্ত কার্য পরিস্থিতিতে (Given action Situation) জনসাধারণ ঐ পরিস্থিতিকে যে পরিচিতি দেয় ও অর্থ আরোপ করে সেগুলো দ্বারাই ব্যক্তি আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। এমনি করে আচরণ কার্যত কোনোও বহি উৎসসম্পন্ন উদ্দীপকের প্রতি স্বয়ংক্রিয় বা স্বভাব সাড়া নয় বরং তা নিজের, অন্যান্যের ও পরিস্থিতির সামাজিক চাহিদার বিষয়ধর্মী গঠনের ফলশ্রুতি।

পরিশেষঃ যোগাযোগের মাধ্যম দ্বারা মূলত মানুষ একে অপরের সাথে, দেশ, জাতি, সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। মাধ্যমগুলো তাদের বিভিন্ন পরিবেশনা ও বিবরণীর মধ্যদিয়ে যেসব সভ্যতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেয় শ্রোতা দর্শক তা আত্মস্থ করে থাকে। যোগাযোগ গবেষণার ব্যবহৃত জটিল প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম জটিল ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্যারাডাইস। কেননা প্রতিকী মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে প্রতিক্রিয়া করে থাকে। তাই ব্যক্তি ও সমাজের একে অপরের প্রতি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার জন্য প্রতিকী মিথষ্ক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Rate this post