খলিফা হযরত ওসমান (রা) এর শাহাদাতের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ হযরত ওসমান (রা) ছিলেন ইসলামী খেলাফতের সুযােগ্য ও দায়িত্ববান খলিফা। তার নম্রতা, খােদাভীরুতা এবং সততাকে দুর্বলতা ভেবে একদল চক্রান্তকারী তার বিরুদ্ধে নানা অমূলক অভিযােগ উত্থাপন করে এবং ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়ােগকারী এ মহান নেতাকে হত্যা করে। এ হত্যার ফলাফল ব্যক্ত করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন- The murder of Ofhman was more epochmaking than almost any other event of Islamic History.

হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যার কারণঃ

হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতের শেষ ৬ বছর ছিল সংকটময়। তার বিরােধীরা রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অচলাবস্থা ও গােলযােগপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টির নানা অজুহাত দেখিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। অবশেষে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিকগণ এ মহান খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও হত্যার যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন তা নিম্নরূপ-

১. গণতান্ত্রিক শাসনের অপব্যবহারঃ হযরত মুহাম্মদ (স) গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফার সময়েও তা মেনে চলা হতাে। এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযােগে অবাধ মেলামেশা, বাকস্বাধীনতা, সমালােচনার পূর্ণ অধিকার ভােগের সুযােগে বিদ্রোহীরা ওসমান (রা)-এর খেলাফতে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের সর্বত্র অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

২. আদর্শচ্যুতি ও বিজ্ঞ সাহাবীদের অনুপস্থিতিঃ প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফার আমলেই বিজ্ঞ সাহাবীগণ ইন্তেকাল করেন। যারা জীবিত ছিলেন তারাও ওসমান | (রা)-কে প্রয়ােজনীয় সাহায্য সহযােগিতা করতে পারেননি। অন্য দিকে মুসলমানদের মধ্যে ধনসম্পদের বৈষম্য, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, হিংসাবিদ্বেষ এবং বিলাসিতা বেড়ে যায়, স্বার্থবাদীরা ক্ষমতা দখল করার সুযােগ খুঁজতে থাকে।

৩. স্বজনপ্রীতির কল্পিত অভিযােগঃ তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল, তিনি মহানবী (স)-এর প্রিয় সহচরদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন পদে নিজের আত্মীয়স্বজনদের নিয়ােগ দিয়েছেন। যেমন-

ক. কুফার গভর্নর পদে বৈমাত্রেয় ভাই ওয়ালিদ ইবনে ওকবাকে নিয়ােগ করেন।

খ. বসরার গভর্নর পদে নিজ চাচা আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে নিয়ােগ করেন।

গ. রাসূল (স) কর্তৃক মদিনা থেকে বহিস্কৃত মারওয়ানকে রাষ্ট্রীয় সচিব পদে নিয়ােগ করেন।

৪ কুরআন দগ্ধীভূতকরণঃ হযরত ওসমান (রা) কুরআন পাঠে পার্থক্য অনুধাবন করে যায়েদ ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে একটি বাের্ড গঠন করে হযরত হাফসা (রা)-এর কাছে সংরক্ষিত কুরআনের পাণ্ডুলিপির অনুকরণে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে বাকিগুলাে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। র ঘটনাকে অনেকে ইস্যুতে পরিণত করেন।

৫. বায়তুল মালের অর্থ অপচয়ের কল্পিত অভিযােগঃ হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে এক শ্রেণির মতলববাজ লোেক রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ অপব্যয়, অপচয় ও আত্মসাতের কল্পিত অভিযােগ উত্থাপন করে। এ ভিত্তিহীন কল্পিত অভিযােগ পরবর্তীতে খলিফা হত্যার মতাে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

৬. প্রাসাদ নির্মাণের অপবাদঃ হযরত ওসমান (রা) ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য একটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করায় এক দল লােক তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানাের উদ্দেশ্যে জোট গঠন করে। অথচ এ কাজ মােটেই অপচয়ের শামিল হতে পারে না।

৭. আবু যর গিফারীর নির্বাসনঃ হযরত আবু যর গিফারী (রা) ছিলেন অতিমাত্রায় দুনিয়াত্যাগী মানুষ। তার অর্থনৈতিক দর্শন ছিল, মৌল মানবীয় প্রয়ােজনের অধিক অর্থসম্পদ কেউ জমা করতে পারবে না। অথচ এ দর্শনের আলােকে জীবনযাপন ছিল সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য অতিশয় কষ্টকর। এ অর্থনৈতিক দর্শন বাস্তবায়ন . সংক্রান্ত বিষয়ে হযরত ওসমান (রা)-এর সাথে তার মতবিরােধের সৃষ্টি হলে তিনি স্বেচ্ছায় রাবাযা নামক পল্লী এলাকায় বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন।

৮. কাবাঘর সম্প্রসারণে বিরােধঃ ওসমান (রা) কাবাঘর সম্প্রসারণ কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিলে জমির মালিকগণ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফতকালে তারা এ জমি স্বেচ্ছায় দান করেছিল, অথচ হযরত ওসমানের আমলে এসে তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। এ অন্যায় দাবিও বিরোধ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৯. ক্রয়-বিক্রয় বন্ধঃ রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য খলিফা কিছু জিনিসের ক্রয়-বিনয় নিষিদ্ধ এবং কিছু জিনিস ক্রয়-বিক্রয় বাধ্যতামূলক করেন।

১০. হাশেমী ও উমাইয়া দ্বন্দ্বঃ হযরত ওসমান (রা) ছিলেন উমাইয়া গােত্রের; কিন্তু হাশেমী গােত্রের লােকেরা চেয়েছিল তাদের মধ্য থকে খলিফা নিযুক্ত হােক। এজন্য হাশেমীরা খলিফাকে সহযােগিতা তাে করেইনি; বরং সুযােগ পেলেই তার সাথে কলহে লিপ্ত হয়েছে।

১১. কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্বঃ হযরত ওসমান (রা) ওমর (রা)-এর নীতি পরিবর্তন করে কুরাইশদেরকে আরবের বাইরে বিজিত অঞ্চলে জমিজমা খরিদ করার সুযােগ দেন। এতে কুরাইশ ও অকুরাইশ জমির মালিকদের মধ্যে বিরােধ দেখা দেয়। বসরা ও কুফায় এ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

১২: অমুসলিম সম্প্রদায়ের অসন্তোষঃ ইসলামের উন্নতি ও অগ্রযাত্রাকে অমুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ করে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকরা ভালাে চোখে দেখেনি। পূর্ণ ধর্মীয় ও নাগরিক সুযােগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও তারা সবসময় ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা পােষণ করে এবং বিদ্রোহীদের সাথে খলিফার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যােগদান করে।

১৩. খলিফার সরলতা ও উদারতাঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর সরলতা ও উদারতা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ বলে অভিহিত করা হয়। তিনি শাসনকার্যে কঠোরতা ও বলিষ্ঠতা প্রদর্শন করতে পারেননি। তার নিজের কারণে একজন মুসলিমের সামান্যতম রক্তপাত হােক তা তিনি কখনােই চাননি।

১৪. আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে বৈষম্যঃ প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফার আমলে আনসার মুহাজির নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে ইসলামের খেদমতে অবদান রেখে গেছেন। তাদের মধ্যে কোনাে দ্বন্দু ছিল না, কিন্তু ওসমান (রা)-এর আমলে মুহাজিরগণ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অবহেলিত হতে থাকে। এমনকি মজলিসে শূরার সদস্যপদ থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়। এতে তাদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে তার হত্যাকাণ্ডকে ত্বরান্বিত কর।

১৫. জনপ্রিয় শাসনকর্তাদের অপসারণঃ হযরত ওসমান (রা) বিভিন্ন প্রদেশের জনপ্রিয় শাসকদের সরিয়ে তাদের স্থলে উমাইয়া বংশীয় অদক্ষ ও অত্যাচারী। শাসকদের নিয়ােগ করেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে যায়।

১৬. ইবনে সাবার অপপ্রচারঃ আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামে এক ইয়েমেনী ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করে নিজ স্বার্থসিদ্ধি তথা ইসলামী খেলাফত ধ্বংস করার জন্য বসরা, কুফা ও মিসরে গমন করে অপপ্রচার চালায় যে, হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফত নীতি বহির্ভূতভাবে হয়েছে। মূলত খেলাফতের যােগ্য হচ্ছেন হযরত আলী (রা) ঐতিহাসিক ইমামুদ্দিন বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে সাবার প্রচারণা, ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করলে পারস্যভাবাপন্ন এবং উত্তরাধিকার সূত্রে রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ইরাকের আরব গােত্রগুলাের অনেকগুলােই তার প্রচারণা সমর্থন করে।

১৭. কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষঃ অবস্থার পরিবর্তন ও কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিদ্রোহ সৃষ্টি এবং হত্যার অন্যতম কারণ ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন অনভ্যস্ত দুরন্ত আরবদের কাছে ভালাে লাগেনি। এছাড়া আরব যােদ্ধাদের আয়ের উৎস। ফায়ভূমি ওমর (রা)-এর সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে যায়। ওসমান (রা)-এর সময়ে তারা ফায়ভূমির সমস্ত আয় দাবি করে। ওসমান (রা) পূর্ববর্তী খলিফার রাজস্ব নীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করলেও আরব যােদ্ধাদের দাবি মেনে নিতে পারলেন না। ফলে তাদের অসন্তোষ বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে।

১৮. সামরিক স্থিতিশীলতাঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর খেলাফতের শেষের বছরগুলােতে সামরিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় নতুন অভিযান বন্ধ হয়ে গনীমত ও ফায় আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়টাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির লােক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং খলিফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

১৯. মারওয়ানের ধ্বংসাত্মক আচরণঃ হযরত ওসমান (রা)-এর উদারতার সুযােগে উমাইয়া বংশােদ্ভূত মারওয়ান নিজ বংশের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য স্বগােত্রীয় লোকদের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে বসান। সকল পদ থেকে হাশেমীদের বঞ্চিত রাখেন। তর স্বার্থপরতা মুসলিম সাম্রাজ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং সরলমতি খলিফার নির্মম পরিণতি ডেকে আনে।

২০. মারওয়ানের জাল পত্র প্রেরণঃ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলে মারওয়ান কর্তৃক ওসমান (রা)-এর নামে মিসরের গভর্নরের নিকট এ মর্মে পত্র প্রেরণ করে যে, বিদ্রোহীরা সেখানে পৌছলে তাদের যেন হত্যা করা হয়। ঘটনাচক্রে সে চিঠি বিদ্রোহীদের হস্তগত হলে তারা খলিফাকে হত্যার জন্য পাগলপারা হয়।

২১. বিদ্রোহীদের মদিনায় উপস্থিতিঃ মারওয়ানের পত্র বিদ্রোহীদের হস্তগত হলে হজ্জের মৌসুমে তারা মদিনায় উপস্থিত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করে।

হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতঃ

খলিফা হযরত ওসমান (রা) বিদ্রোহীদের দাবি দাওয়া মেনে নিলে তারা স্বস্ব স্থানে ফিরে যেতে থাকে, কিন্তু পথিমধ্যে মারওয়ানের চক্রান্তে লিখিত খলিফার মােহরাঙ্কিত একটি জাল পত্র তাদের হস্তগত হয়। এতে নির্দেশ ছিল, বিদ্রোহীরা কুফায় পৌছামাত্র তাদের হত্যা করবে। ফলে বিদ্রোহীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পুনরায় মদিনায় ফিরে আসে। তারা ৪০ দিন মদিনা অবরােধ করে রাখে। অবশেষে ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন মােতাবেক ৩৫ হিজরীর ১৮ যিলহজ তারিখে বিদ্রোহীরা মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের নেতৃত্বে জোরপূর্বক ওসমান (রা)-এর গৃহে প্রবেশ করে। কুরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় তাকে হত্যা করে। তখন তার বয়স ছিল ৮২ বছর। খলিফার স্ত্রী নায়েলা তাকে রক্ষা করতে গিয়ে হাতের আঙুল হারান। হিট্টি বলেন, “এরূপে মুসলমানদের দ্বারা রক্তপাতে নিহত তিনিই প্রথম খলিফা।”

ওসমান (রা)-এর হত্যার ফলাফলঃ

হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যার ফলাফল দু’ভাবে পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ক. প্রত্যক্ষ ও খ, পরােক্ষ।

ক. প্রত্যক্ষ ফলাফলঃ

১. খেলাফতের মর্যাদাহানীঃ খেলাফত একটি পবিত্র আসন। কিন্তু ওসমান (রা)-এর হত্যার ফলে খেলাফত ও খলিফার প্রতি জনসাধারণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভক্তি শিথিল হয়ে যায়।

২. ঐক্য বিনষ্টঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের ফলে মুসলমাদের মধ্যে যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংহতি ছিল তা বিনষ্ট হতে শুরু করল। এর ফলে ইসলামী মূল্যবােধের অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে।

৩. ইসলামের শক্তি ও সংহতি বিনষ্টঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ফলে ইসলামের শক্তি ও সংহতি ভেঙ্গে খান খান হয় যায়। অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহারযােগ্য মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সংহতি শক্তি এবার নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে ব্যবহারের পথ খুলে যায়।

৪. শােকের ছায়াঃ হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ফলে সাহাবীগণ শােকে পাথর হয়ে যান। তাদের অনেকেই বেঁহুশ হন, অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।

৫. হিংসার সৃষ্টিঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আরবদের মধ্যে অন্ধকার যুগের পুরনাে শত্রুতা জেগে ওঠে এবং সমাজ জীবনে অরাজকতা দেখা দেয়।

৬. প্রতিহিংসার সৃষ্টিঃ ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উপদ্বীপে জাহেলী যুগের প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি আবার জাগ্রত হয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

৭. কেন্দ্রীয় শাসন উপেক্ষাঃ সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া (রা) মদিনা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করে ওসমান (রা)-এর হত্যার প্রতিশােধ নিতে তৎপর হন।

৮. বিজয়াভিযান স্থগিতঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের ফলে ইসলামের বিজয়াভিযান বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে খেলাফতের মসনদে আসীনদের বাহবিশ্বের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মনােযােগী হতে হয়।

৯. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তিঃ তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডের ফলে হসলামের একতা বিনষ্ট হয়। বিভিন্ন কার্যাবলির প্রতিবাদে বিভিন্ন মতবাদ ও দল উপদলের উদ্ভব হয়, তা পরবর্তীকালে মুসলিম উম্মাহকে শতধা বিভক্ত করে। মুসলিম জাতি শিয়া, সুন্নী, খারেজী, রাফেযী প্রভৃতি ফেরকা বা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

খ. পরােক্ষ ফলাফলঃ

১. মদিনার প্রাধান্য লোপঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের ফলে মদিনার প্রাধান্য লােপ পায়। কেননা পরবর্তী খলিফাগণ সুবিধামত রাজধানীকে কুফা,দামেস্ক, বাগদাদ, কায়রাে, কর্ডোভায় স্থানান্তর করে। ফলে মদিনার রাজনৈতিক মর্যাদা কমে যায়। মদিনা একটি পবিত্র ধর্মীয় নগরী হিসেবে পরিগণিত হয়।

২. ইসলামী গণতন্ত্রের বিলুপ্তির সূচনাঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর হত্যার ফলে ইসলামী রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ধীরে ধীরে রাজনীতি হতে সরে দাড়ায়। ফলে চতুর্থ খলিফার খেলাফতের অবসান হওয়ার সাথে সাথে ইসলামী গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং রাজতন্ত্রের উত্থান শুরু হয়।

৩. হযরত আলী (রা) খলিফা নির্বাচিতঃ ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহী ওসমান হত্যাকারীরা অনেকটা জোরপূর্বক হযরত আলী (রা)-কে খলিফা নির্বাচিত করে।

৪. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হাতে ক্ষমতাঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের কুফল স্বরূপ সৃষ্ট রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে বহু আরব গােত্র জন্মভূমি পরিত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে বসবাসের জন্য চলে যায়। ফলে রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হাতে বহুলাংশে হস্তান্তর হয়।

৫. সুদূরপ্রসারী প্রভাবঃ হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের ফলেই পরবর্তীতে সিফফীনের যুদ্ধ, উষ্ট্রের যুদ্ধ, কারবালার যুদ্ধ প্রভৃতি মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়। হযরত আলী (রা)-এর খেলাফতকালে যে কয়টি গৃহযুদ্ধ হয়, তা এ হত্যাকাণ্ডের ফলেই হয়েছে।

উপসংহারঃ হযরত ওসমান (রা)-এর রক্তপাতের করুণ পরিণতি ইসলামের ইতিহাসকে সংকটাপন্ন করে তােলে, খেলাফতের নৈতিক ও ধর্মীয় মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। সর্বোপরি এ দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডই পরবর্তীতে কারবালার মর্মান্তিক বিয়ােগান্তক ঘটনার জন্ম দেয়। তাই ঐতিহাসিক জোশেফ হেল বলেন- The murder of Oihman was signal for civil war.

5/5 - (2 votes)