প্রশ্নঃ সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলােচনা কর।

অথবা, সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান মানুষের সংস্কৃতি বিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ পাঠ। মানুষের আচার আচরণ, ভাষা-সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, কৎকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান পূর্ণাঙ্গ বা holistic দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা চালায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজের মানুষের ‘Social and cultural development and behavior of human being.’ সম্পর্কে আলােচনা করে। তাই অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান ও ইতিহাসের এক গভীর যােগসূত্র রয়েছে।

সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণাঃ সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের সাথে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সম্পর্ক আলােচনা করার আগে সেগুলাে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা জরুরি। তাই আমরা নিচে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানসহ সমাজবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান ও ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করতে পারি।

সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানঃ নৃ-বিজ্ঞানের দু’টি মৌলিক শাখা-দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য হলাে সংস্কৃতি। এটা সংস্কৃতির উদ্ভব, বিকাশ এবং যুগ ও এলাকাভেদে মানবসংস্কৃতির বিচিত্র রূপ এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে আলােচনা করে।

সমাজবিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজের গঠন প্রণালি এবং পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামাে সম্পর্কে কার্যকারণ সম্পর্কভিত্তিক পাঠ তথা বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ। এটা সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে আলােচনা ও গবেষণা করে।

সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানঃ সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে এবং মানুষ ও তার সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক পাঠ হিসেবে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান একটি অপরটির পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান সম্ভবপর নয়। এদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্যও আছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্কঃ সমাজবিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের মধ্যে বেশ কিছু সম্পর্ক রয়েছে। নিম্নে তা আলােচিত হলাে-

(১) আধুনিক সমাজ ও তার মানুষের অধ্যয়ন হিসেবে সমাজবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের সম্পর্ক গভীর। সমাজবিজ্ঞান যেমন আধুনিক সমাজের বিজ্ঞান, তেমনি নৃ-বিজ্ঞান আদিম মানুষ ও সমাজের পাশাপাশি আধুনিক মানুষ ও সমাজ নিয়ে আলােচনা করে।

(২) সমাজবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয় হলাে সমাজ। আর সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয় হলাে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন। যেহেতু সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে মানুষকে নিয়েই সমাজ গঠিত হয়, তাই উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

(৩) সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তন সমাজবিজ্ঞানী নৃ-বিজ্ঞানের সাহায্যে তুলে ধরেন। আবার সামাজিক ঘটনা প্রবাহ সমাজবিজ্ঞানে চিত্রিত হওয়ায় নৃ-বিজ্ঞানী তার গবেষণা কাজে সমাজবিজ্ঞানের সাহায্য নেন।

(৪) সমাজবিজ্ঞান থেকে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানকে আলাদা করা যায় না। অনেকে এদেরকে একই বিষয়ের দুটি অঙ্গ মনে করেন। আবার অনেকে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞানের একটি অংশ মনে করেন।

সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্যঃ সমাজবিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের মধ্যে উপযুক্ত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন-

(১) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলাে মানুষ ও তার সংস্কৃতি। পক্ষান্তরে, সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলাে সমাজ এবং সমাজ সম্পর্কিত পাঠ।

(২) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানে Holistic তথা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা করা হয়। এজন্য একজন নৃ-বিজ্ঞানী সমাজের কোনাে কিছুকে আলাদা করে দেখেন না। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম Holistic দষ্টিভঙ্গির অবকাশ নেই।

(৩) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানে ক্ষুদ্র সমাজ নিয়ে গবেষণা করা হয়। যেমন- ট্রাইব, গ্রাম, সম্প্রদায় ইতাদি। পক্ষান্তরে, সমাজবিজ্ঞান বৃহৎ সমাজ নিয়ে গবেষণা করে। যেমন- বাংলাদেশের সমাজ।

(৪) একজন নৃ-বিজ্ঞানী ক্ষুদ্র পরিসরে গবেষণা করেন বিধায় তিনি এ সমাজের পুখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে পারেন। কিন্তু একজন সমাজবিজ্ঞানী বৃহৎ সমাজের সাধারণ আলােচনা তুলে ধরেন।

(৫) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের গবেষণা ক্ষেত্র সমাজবিজ্ঞানের চেয়ে ব্যাপক। কেননা সমাজবিজ্ঞান যেখানে আধুনিক সমাজ নিয়ে আলােচনা করে, সেখানে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান আদিম সমাজ থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত আলােচনা।

(৬) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের চেয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনেক বেশি পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়।

(৭) সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানে যেখানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সমাজবিজ্ঞানে সেখানে পরিসংখ্যান ও প্রশ্নমালার সাহায্য নেয়া হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এবং ভৌগােলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সর্বকালের সব সমাজের মানুষের আচার-আচরণ, প্রথা-বিশ্বাস, সংস্কৃতি, কৃৎকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে আলােচনা করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও মনােবিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

Rate this post