আদি-মধ্যযুগের ভারতে ‘নাথধর্ম’ বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। ‘শিব’কে কেন্দ্র করে যোগসাধনার মাধ্যমে একদল মানুষ মোক্ষলাভে প্রয়াসী হন। এঁরাই ‘নাথযোগী সম্প্রদায়’ নামে পরিচিত হন। এঁদের আদিগুরু শিব। যিনি ‘আদিনাথ’ নামেও জনপ্রিয়। আদিনাথের অনুগামী হিসেবে এঁরা নাথ সম্প্রদায় নামে অভিহিত হন। আদি-মধ্যযুগের সংস্কৃত ও আঞ্চলিক সাহিত্যে নাথ সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’, ‘আগম সংহিতা’, ‘পরাশর সংহিতা’, ‘তন্ত্রালোক’ প্রভৃতি গ্রন্থে শৈবনাথ ধর্ম সম্পর্কে নানা আলোচনা আছে। ভারতের নানাস্থানে এঁদের মঠ ও সাধনকেন্দ্র আছে। তবে শিব আদিনাথ হলেও গুরু গোরক্ষনাথই নাথ সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু। নাথধর্মের কেন্দ্রে আছেন গোরক্ষনাথ। কেউ কেউ গোরক্ষনাথকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করেন। কথিত আছে, অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যবর্তীকালে যে-কোনো সময় তিনি মানবদেহে মর্ত্যধামে বিরাজ করেছিলেন। ভারতের নানাস্থানে তাঁর আবির্ভাব-সংক্রান্ত কাহিনি প্রচলিত আছে। এ বিষয়ে প্রচলিত গরিষ্ঠ মতটি হল যে, গোরক্ষনাথ পাঞ্জাবের কোনো অঞ্চলে জন্ম নেয় এবং পরে বিহারের গোরক্ষপুরে বসবাস করে তাঁর দর্শনও প্রচার করেন।

ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, গোরক্ষনাথ দশম-দ্বাদশ শতকের পরবর্তী ছিলেন না এবং সম্ভবত তিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে শিব-মৎস্যেন্দ্রা নাথের পৌরাণিক আখ্যানের সাথে তাঁর কাহিনি যুক্ত করে তাঁকে পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত করা হয়েছে। তাই মধ্যযুগে নাথপন্থীরা ‘গোরক্ষপন্থী’ নামেও পরিচিতি লাভ করেন। দশম শতক থেকে সারা উত্তর ভারতে গোরক্ষপন্থী নাথ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায়। পশ্চিম ভারতেও এদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাংলাদেশেও অতি প্রাচীনকাল থেকে এই সম্প্রদায় সাধন-ভজন করে আসছেন। বর্তমানেও নানা শাখা প্রশাখায় নাথপন্থীরা বাংলায় ছড়িয়ে আছেন। যোগসাধনার মাধ্যমে এঁরা মুক্তির পথ অনুসরণ করতেন। এই অর্থে তাঁরা ‘যোগী’, কিন্তু শব্দটি ভ্রষ্ট হয়ে ‘যুগী’ এই অপশব্দে পরিণত হয়েছে। উত্তর ভারতের বহু স্থানে নাথপন্থীরা ‘কান্-ফট যোগী হিসেবে পরিচিত। এঁরা কান ফুটো করে একজাতীয় অলংকার ধারণ করেন। একে বলা হয় ‘মুদ্রা’ বা ‘দর্শন’ বা ‘কুন্তল’। এই যোগীরা ত্রিশূল ও রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন এবং শিবরাত্রি উৎসব পালন করেন। এঁদের দেবতাদের মধ্যে আছেন নিরঞ্জন, শূন্য, আদিনাথ ও অনাদিনাথ। এর ভিত্তিতে ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন যে, নাথধর্মের ওপর শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ ও জৈন সব ধর্মেরই প্রভাব আছে। নাথধর্মে নয়জন গুরুর কথা জানা যায়। বৌদ্ধ ‘সহজযান’ বা ‘কালচক্রযান’-এর সিদ্ধাচার্যদের সাথে এই নবম নাথের পূজাও প্রচলিত ছিল। চর্যাপদে নাথধর্ম ও নাথগুরুদের উল্লেখ পাওয়া যায়। নাথ সাহিত্যে উল্লিখিত নয়জন নাথগুরু হলেন—পূর্বে গোরক্ষনাথ, উত্তরাপথে জালন্ধর, (জ্বালামুখী তীর্থে), দক্ষিণে নাগার্জুন, পশ্চিমে দত্তাত্রেয়, দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবদত্ত, উত্তর-পশ্চিমে জড়ভরত, কুরুক্ষেত্রে ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ-পূর্বের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যেন্দ্রনাথ (বাংলায় মীননাথ)। মারাঠি বৃত্তান্ত অনুসারে আদিনাথ শিবের কাছে ‘মহাজ্ঞান’ লাভ করেন তাঁর ঘরনি পার্বতী, মৎস্যেন্দ্রনাথ ও জালন্ধর। মৎস্যেন্দ্রনাথের কাছে দীক্ষা নেন গোরক্ষনাথ ও চোরঙ্গীনাথ। জালন্ধরের দুই শিষ্য কানিফা বা কানুপা ও ময়নামতী। গোরক্ষনাথের দুই শিষ্য গৈনীনাথ ও চপটিনাথ। এঁরাও অনেককে দীক্ষা দিয়ে শিষ্যত্বে বরণ করেছেন।

ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-র মতে নাথপন্থার উদ্ভব নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যেই ঘটেছিল। এই ধর্মমতের ওপর জৈন ও আজীবিক ধর্মের গভীর প্রভাব ছিল। দক্ষিণ ভারতের মাহেশ্বর সিদ্ধ নামক যে সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে, তারাই মূল নাথপন্থী। এঁদের প্রধান সিদ্ধাই হলেন শ্রীমূলনাথ। তত্ত্বের দিক থেকে এঁরা শৈব ও শাক্ত আগমসমূহ থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এঁদের লক্ষ্য ছিল রহস্যময় (নিগূঢ়) পদ্ধতিতে সিদ্ধিলাভ করা।

সহজিয়া সাধকদের মতো নাথপন্থীরা প্রচলিত বেদ বিধিসম্মত পূজা ও আচার-আচরণের বিরোধী ছিলেন। প্রাচীন ভারতে কোনো কোনো দর্শনতত্ত্বে জড়দেহকে মুক্তির পথে বাধা না-ভেবে মুক্তির সোপান হিসেবেই দেখা হত। তাঁরা নানা ধরনের যোগ, তন্ত্রাচার, রাসায়নিক ও আয়ুর্বেদীয় ভেষজবিদ্যার সাহায্যে জড়দেহকে পরিশুদ্ধ করে তাকে মোক্ষ বা মুক্তিলাভের উপযোগী করে তুলতেন। পতঞ্জলির যোগদর্শন এবং তন্ত্রাচার ও হঠযোগ দ্বারা তাঁরা জড়দেহকে দিব্যদেহে পরিণত করতে চেষ্টা করতেন। এইভাবে যোগদর্শন ও কায়াসাধনার মাধ্যমে এই যোগীরা ভঙ্গুর জীবনকে অমর অজর ও প্রাজ্ঞ করে তুলতে প্রয়াসী হতেন। যোগসাধনার দ্বারা প্রাণায়াম ক্রিয়ার সাহায্যে এঁরা শ্বাসপ্রশ্বাসকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। পূরক-কুম্ভক-রেচক ইত্যাদি বায়ু বশীভূত করে মোক্ষলাভের প্রথম সোপান অতিক্রম করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তন্ত্রসার অনুসারে কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্ব অবলম্বনে নিজ দেহের মধ্যে শিব-শক্তির মিলন-সম্ভূত দিব্যানুভূতি লাভ করতে সক্ষম হন। এই পর্যায়ে উপনীত হলে জড়দেহ দিব্যদেহে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ নাথপন্থীদের সাধনার লক্ষ্য দ্বিবিধ। একটি হল চরম লক্ষ্য শিবত্ব অর্জন বা পরামুক্তি ; অন্যটি হল তাৎক্ষণিক লক্ষ্য অর্থাৎ জড়দেহের মধ্যে থেকেই মুক্তি অর্জন করা। এঁদের মতে, জীবনমুক্তির মধ্য দিয়েই পরামুক্তি সম্ভব। জীবনমুক্ত সাধক সর্ববিধ কামনা-বাসনাকে জয় করেন। মৃত্যু তাঁর কাছে পরাভূত হয়। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে সাধক নিজে শিব বা আদিনাথে বিলীন হয়ে যান। নাথপন্থীদের সাধনপথের বাধা হিসেবে রমণীরা বিবেচিত হতেন। কারণ দেহস্থিত রস শোষণ করেই নাথেরা জীবনমুক্ত হন। কিন্তু নারী সেই দেহরস অপচয়ের কারণ হিসেবে বিবেচিত হতেন। দেহরস আত্মীকরণের যৌগিক পদ্ধতি সম্পর্কে গুহ্যরীতি ও গুরুবাদ অনুসরণ করা হত।

বাংলা সাহিত্যে আদিনাথ শিব, পার্বতী, মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথ, গোরক্ষনাথ, জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা, রানি ময়নামতী, কানুপা (জালন্ধরের শিব) এবং ময়নামতীর একমাত্র পুত্র গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ছড়া, কবিতা ও পাঁচালি লেখা হয়েছে। এর মধ্যে মীননাথ ও গোরক্ষনাথের কাহিনিকে ভিত্তি করে একাধিক পুঁথি লেখা হয়েছে। অন্যদিকে ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের সম্পর্কে অধিকাংশই মৌখিক ছড়া পাওয়া গেছে। নাথসাহিত্যের আখ্যান বাংলার বাইরেও প্রচলিত ছিল। তবে সেক্ষেত্রেও এই দুটি আখ্যান প্রাধান্য পেয়েছে। ড. সুকুমার সেনের মতে, নাথসাহিত্যের চরিত্রগুলির ওপরে বাংলার বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। তাঁর মতে, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব বাংলা নাথধর্মের উৎপত্তিস্থল। বাংলার অতি জনপ্রিয় বাউলধর্ম আদতে নাথধর্মেরই পরিবর্তিত রূপ বলে ড. সেন মনে করেন।

বাংলাদেশে গোরক্ষনাথের মহিমাভিত্তিক দু-ধরনের বই লেখা হয়। একটি ‘গোরক্ষবিজয়’ বা ‘গোর্খবিজয়’ এবং অন্যটি ‘মীনচেতন’। দুটি গ্রন্থেই গোরক্ষনাথের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংযম ও কর্তব্যবোধের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গোরক্ষবিজয়-সম্পর্কিত তিনটি পুঁথি ছাপা হয়েছে—(১) কবি শ্যামাদাস সেন বিরচিত এবং ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত ‘মীনচেতন’ (১৯১৫ খ্রিঃ), (২) শেখ ফয়জুল্লা বিরচিত ও মুন্সি আব্দুল করিম সম্পাদিত ‘গোরক্ষবিজয়’ (১৯১৭ খ্রিঃ) এবং (৩) ভীমসেন বিরচিত ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত ‘গো/বিজয়’ (১৯৪১ খ্রিঃ)। এখন এই তিনটি পুঁথি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিনা এবং এদের রচনাকাররা পৃথক ব্যক্তি কিনা, সে বিষয়ে কিছুটা জটিলতা আছে।

ড. আহমেদ শরিফ মনে করেন, ‘গোরক্ষবিজয়ের’ রচয়িতা শেখ ফয়জুল্লা। ভীম সেন লিপিকর অথবা গায়েন অথবা দুই-ই হতে পারেন। ড. করিম মনে করেন, মূল কাব্যটির নাম সম্ভবত ‘মীনচেতন-গোরক্ষবিজয়’ বা ‘গোরক্ষবিজয়-মীনচেতন ছিল। পরে নানা লিপিকারের হাতে পড়ে পৃথক পৃথক নামে অভিহিত হয়েছে। এই গ্রন্থের কাহিনি আকারে সংক্ষিপ্ত। গুরু মীননাথ কদলী রাজ্যে গিয়ে মোহগ্রস্ত হন। তাঁর সাধন জ্ঞান-সিদ্ধি লোপ পায়। মৃত্যু আসন্ন হয়। গোরক্ষ নটীর ছদ্মবেশে কদলীরাজ্যে প্রবেশ করে নৃত্যগীতের হলে গুরুকে কায়সাধনার জ্ঞান দিয়ে প্রলোভন থেকে উদ্ধার করেন। এর কাব্যগুণ খুবই কিঞ্চিৎ, তবে নৈতিক গুণ কিছুটা আছে।

ড. ক্ষেত্র গুপ্তের মতে, মানবজীবন সম্পর্কে বিরূপতা এঁদের দৃষ্টিকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, মানবজীবন ও হৃদয়ের স্বাভাবিক বিকাশগুলি গুরুত্ব পায়নি। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, স্বল্প প্রতিভার অর্ধশিক্ষিত মানুষেরা এগুলি রচনা করতেন। ফলে লোকসাহিত্য হিসেবে আদৃত হলেও; এদের রচনায় সাহিত্যগুণ খোঁজা বৃথা। তবে আকারবিশিষ্ট ঈশ্বর-চেতনা নাথকায় মুসলমান সাধকেরাও নাথপন্থীর অনুসারী হতে পেরেছিলেন। ময়নামতী-গোপীচন্দ্র-বিষয়ক আখ্যান কাব্যে দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস ও সুকুর মহম্মদ—এই তিনজন কবির নাম পাওয়া যায়। দুর্লভ মল্লিকের রচনা সংক্ষিপ্ত এবং কাব্যগুণবর্জিত। ধর্মতত্ত্বের প্রতি আনুগত্য বেশি। অন্য দুজনের রচনা তুলনামূলকভাবে বিস্তারিত ও লোককাহিনিতে সমৃদ্ধ।

আখ্যানকাব্য ও পাঁচালি ছাড়াও বিশুদ্ধ তত্ত্বদর্শন-বিষয়ক কিছু ছড়া পাওয়া গেছে, যা নাথধর্মের সাথে সম্পর্কিত। এগুলি হল— ‘যোগীর গান’, ‘যুগীকাচ’, ‘গোর্খসংহিতা’, ‘যোগ-চিন্তামনি’ প্রভৃতি। এগুলিতে কোনো কাহিনি নেই, কেবল কায়সাধন প্রসঙ্গে নানাপদ সংকলিত হয়েছে। এখানে দেহকে অমর করার কৌশল, হঠযোগ, তন্ত্র ইত্যাদি নাথ যোগতত্ত্ব রূপকের ছলে বিবৃত হয়েছে। যুগীরা এই গান গেয়ে ভিক্ষা করেন। শৈবনাথ ধর্ম এখনও ভারতবর্ষে জীবিত আছে।

Rate this post