বীরাঙ্গনায় প্রত্যেকটি নায়িকার মনোভাব স্পষ্টভাবেই উদ্‌ঘাটিত হয়েছে এবং যেভাবে তাদের মনের প্রতিটি দল ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়েছে—তাতে নাটকীয়তা দেখা না দিয়ে পারেনি। পত্রিকাগুলি পাঠকের মনে কখনও কৌতুহল, কখনও বিস্ময়, কখনও অনিশ্চয়তা, কখনও দ্বন্দ্ব কখনও উত্তেজনা আবার কখনও চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় পত্রিকাগুলির মধ্যে নাটকীয় উপাদান আছে। তবে তার মধ্যে ‘সোমের প্রতি তারা’ নাটকীয় উপাদানগুলি সবচেয়ে বেশি স্ফূর্তি লাভ করেছে।

‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রটিতে স্তরে স্তরে নাটকীয় অনুভূতি বিন্যস্ত। সোমদেব তারার স্বামী বৃহস্পতির অথচ পত্রের শুরুতেই দেখা যায় সোমদেবকে সম্বোধন করার জন্য তারা ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই ‘পুরুষ রত্ন’ সম্বোধণে সম্বোধিত করলেন। তিনি দাসী হয়ে তাঁর পা দু’খানি সেবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন।

এই পত্রে তারার সূক্ষ্ম মানসিক দ্বন্দ্বের বিচিত্র অভিব্যক্তি আছে। চন্দ্রকে গুরু পত্নী তারা ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে ভালোবাসার কথা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। এই পত্রে যদিও তিনি মাঝে মাঝে তাঁর মনের কথা এবং চন্দ্রের প্রতি তাঁর পূর্ববর্তী আচার ব্যবহারের কারণ বিশ্লেষণ করে চন্দ্রকে তাঁর অপ্রতিরোধ্য প্রেম নিবেদন করেছেন তবু তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে এসেছে দ্বন্দ্ব, শুরু হয়েছে একান্ত আত্মধিক্কার। তাঁর প্রকৃত সত্তা হয়েছে জাগ্রত। চন্দ্রের প্রতি তাঁর ভালোবাসার এই যে সমাজ নিষিদ্ধ প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও তজ্জনিত অন্তর্দ্বন্দ্ব এর মধ্যে দিয়েই কবিতাটি সার্থক হয়ে উঠেছে।

সোমের অপূর্ব রূপই তারাকে তাঁর প্রতি আকর্ষণ করেছে। অর্থাৎ চন্দ্রের প্রতি তারার রূপজ মোহই এখানে প্রধান। তারা সোমদেবকে প্রথম দর্শনেই ভালোবেসেছেন।

“যেদিন প্রথমে তুমি এ শাস্ত আশ্রমে 

প্রবেশিকা, নিশাকান্ত, সহসা ফুটিল 

নব কুমুদিনী সম এ পরাণ মম

উল্লাসে।”

শ্রেয়েসী ও গুরুমা এই উভয় সত্তার দ্বন্দ্ব তারা চরিত্র একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তারা সোমদেবকে ভালোবেসেছেন, যে সোমদেব তাঁর স্বামীরা শিষ্য। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে তাঁর মন ময়ূরের মতো নাচত! প্রেয়সী সত্তার স্বাভাবিক গুণ প্রিয়জনের ভালোবাসার বস্তুর প্রতি আকর্ষণ। তারাও একই কারণে চন্দ্রের মতো মৃগ শিশু কোলে করে কাঁদেন।

প্রেয়সী সত্তার মূল গুণ হল এই ঈর্ষা। চন্দ্রের পাশে ‘রোহিণীর স্বর্ণ কান্তি লক্ষ্য করে তারার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠত। সপত্নীবলে তাকে গালাগালিও করতেন, চন্দ্রের স্নেহধন্য কুমুদ পুষ্পকে ছিঁড়ে ফেলতেন। কিন্তু তারা নিজের গুরুমা সত্তাকে ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না ‘জনম মম মহা ঋষি কুলে’ তাই একথা ও বলতে ভুল করেন না ‘হায়রে, কি পাপে বিধি এ তাপ লিখিল এ ভালে?’ এবং আরও বলেন ‘কোকিলের নীড়ে কিরে রাখিলি গোপনে কাকশিশু” লেখনীকেও গঞ্জনা দিতে ছাড়েন না তিনি। প্রেয়সী সত্তাকে জাগাবার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝেও আত্মধিক্কার জাগে তাঁর ‘পাপীয়সী’ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করে।

অবশেষে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে তারা। সোমদেবের চরণে নিজেকে সমর্পণ করেন। শেষ মুহূর্তে আর কলঙ্কের ভয় করেন না তারা, তাঁর মনোভাব এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল—

‘দিনু জলাঞ্জলি কুল মানে তব জন্যে’।

তারার প্রেমিকা মূর্তির সত্যিকারের জাগরণ ঘটেছে। প্রেমিকের জন্য তিনি তপস্যায় বসার জন্য মনস্থির করে ফেলেছেন। তাই প্রেমিকের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তারার প্রেমিকা চরিত্রের পূর্ণ প্রস্ফুটন ঘটেছে। তাই তারা বলেছেন—

“জীবন মরণ মম আজি তব হতে।”

এই পত্রটিতে আমরা দেখতে পাই মধুসূদন যেমন নাট্যগুণের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন ঠিক তেমনি প্রেমের নিপুণ ছবি এঁকেছেন। ফলে পাঠকের মন বিগলিত হয়ে যায়।

Rate this post