কবিতার বা সাহিত্যের মূল কাজ ভাষা নির্ভর সৌন্দর্যের সৃষ্টি। বিশ্বস্রষ্টা ব্রয়ার সঙ্গে সাহিত্যস্রষ্টার কর্মের ফারাক থাকে না, তাঁর সৃষ্টি হয়ে ওঠে ‘ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর’। আধুনিক সমালোচনা পদ্ধতিতে এই সৌন্দর্যের গভীরে ডুব দিয়ে তার রহস্য খুঁজে নেওয়ার একটা বাসনা থাকে। সাহিত্য সম্পর্কে আধুনিক ভাবনাচিন্তা ও বিংশ শতকের ভাষা বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক শৈলী বিজ্ঞান। সাহিত্যের ভাষা দৈনন্দিন কাজের ভাষা থেকে আলাদা হয়ে যায়, তার Foregrounding বা প্রমুখন ঘটে। যে বিশেষ রীতিতে সাহিত্য কবিগণ এই প্রমুখন ঘটল তা খুঁজে বেরবারই শৈলী চর্চার উদ্দেশ্য। আর কবি বা সাহিত্যিকরা ভাষার প্রচলিত কাঠামো ভেঙে দিয়ে কিংবা লোকায়ত শব্দ প্রয়োগ করে কিংবা, ছন্দ, অলংকার, চিত্রকল্প সৃষ্টির মাধ্যমে কবিতায় রসসৌন্দর্য সৃজন করেন।

রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের সোনার তরী কবিতা কবির জীবনের এক বিশেষ মুহূর্তের ফসল। জমিদারি সামলানোর কাজে পদ্মার বোটে চড়ে শিলাইদহ সাজাদপুর অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা তাঁর এই পর্বের কাব্যগুলিতে দিয়েছেন। নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষা তাঁর কবিমনকে ঘরে তুলেছিল শৃঙ্খল মুক্ত একঝাঁক পাখির মতো।‘সোনার তরী’ কাব্যের কবিতাগুলিতে এই নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত । তাঁর এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ভাষা চয়নে। যদিও যে কবিতা প্রসঙ্গে নিজেই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন যে এ কবিতায় একটি অখন্ড সৌন্দর্যকে তুলে ধরছে সেটাই মূল কথা। এই চিত্রকল্পকে তুলে ধরার জন্য ছয়টি স্তবকে এবং ত্রিশটি চরণে বিন্যস্ত করে তার মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন নতুন জীবনবোধকে ; কবিতার ভাষার অন্তর্গঠন যার সহায়ক হয়েছে।

‘সোনার তরী’ কবিতাতে এক বর্ষার দিনের কথা আছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে দেখা যায় প্রথম স্তবকটি বর্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে, দ্বিতীয় স্তবকে কবির অবস্থান, তৃতীয় স্তবকে এসেছে নিরুদ্দেশের ডাক, চতুর্থ স্তবকে কবির আহ্বান, পঞ্চম স্তবকে তাঁর অনুরোধ, শেষ স্তবকে তাঁর অপেক্ষা।

প্রথম স্তবকে এসেছে একটি সরলবাক্য। তারপরেই বলেছেন, ‘কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’। আর একেবারে শেষ স্তবকে বলেছেন ‘সূচনা নদীর তীরে রহিনু পড়ি’ বাক্যের সঙ্গে সঙ্গতিরক্ষা করছে। বর্ষার মধ্যে এসেছে ধান কাটার প্রসঙ্গ। দেখতে পাই বাক্যগত সৌন্দর্যের চমকারিত্ব। প্রতি চরণই যেন ছন্দের অনুরণন দিয়ে যায় । যেমন—

  • গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা।
  • রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল যারা।

দ্বিতীয় স্তবকে ছোটো খেতের কথা, যার চারদিকে বাঁকা জল খেলা করছে। পরস্পরের তরুছায়া মসীমাখা সৌন্দর্য বিপরীতে তিনি একথা অবতীর্ণ করছেন, যেন কোনো এক অপেক্ষায়। এই অপেক্ষায় অবস্থানের ইঙ্গিত পাই তৃতীয় স্তবকে। সেখানে কোনো এক দূরাগত আহ্বান শোনা যায়। কবি যেন চেনেন তাকে—

‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে 

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’

চতুর্থ স্তবকে কবির আহ্বান, তাঁর এতকালের সঞ্চিত সম্পদ তুলে দিয়ে ক্লান্ত হতে চান, আগত তরীতে। পরের স্তবকে কবি তাঁর সঞ্চিত সমস্ত তুলে দিয়েছেন তরীতে দ্বিতীয় চরণে ‘—’ চিহ্নটি কবির যেন হতাশকে তুলে ধরেছে। আসলে ‘তাঁর মনে, সেই প্রশ্ন ঠাঁই তাঁর হবে তো’। শেষ চরণে তাই বললেন ‘এখন আমারে লহো করুণা করে। তখন চরণে এল অভিম বাচন। যে যে তরীতে তিনি তাঁর সম্পদ তুলে দিয়েছেন সেখানে তাঁর ঠাঁই নেই। শেষে তাই তিনি শূন্য নদীর তীরে পড়ে রইলেন। আর—যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। কবিতার অন্তর্গঠনে তাঁর ভাবনার মার্জিত প্রতিফলন ঘটেছে, ভাষাও হয়ে উঠেছে তার অনুসারী।

কবিতার শব্দ সজ্জায় এক অপূর্ব প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায়। প্রত্যেকটা স্তবকের অন্তমিলের একটা সৌন্দর্য আছে। ছয়টি স্তবকেই অন্তমিল বিন্যাস একই রকম–কক, খ,গ,গ,। প্রত্যেকটা স্তবকে ড্যাস (—) চিহ্ন বিশেষ ভাবনাকে গতিশীল করে তুলেছে। প্রথম স্তবকের শেষ লাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেছে পূর্ববর্তী লাইনের ড্যাস (−) চিহ্ন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তবকেও এই অর্থই বহন করে এনেছে। চতুর্থ স্তবকে ড্যাস (−) চিহ্ন কবি তরীতে সঞ্চিতফসল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান তার ইঙ্গিত। শেষ দুটি স্তবকে এসেছে কবির নিরাশক্ত চেতনা, এবং শূন্যতার দূত হয়ে।

কবিতার ধ্বনি বিন্যাসের চমৎকারিত্ব লাভ করা যায় সব। যদি যেন ধ্বনির মাধ্যমে ছবির মালা গেঁথেছেন। যেন নদীর প্রবাহের মতো কাজ প্রবাহও বয়ে গেছে তা এসেছে গীতিকাব্যিক মূর্ছনা। শব্দলংকার সৃষ্টির অপূর্ব নজির তাঁর এই কাব্য। অনুপ্রবেশের আধিক্য এই কবিতায় মেলে।—

  • গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা
  • রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা। 
  • যেও যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে দাও।

এর পাশাপাশি অর্থালংকারও চোখে পড়ে। যেমন—

  • সমাসোক্তি— ‘ভরা পালে চলে যায়। কোনো দিকে নাহি চায়’

  • অতিসয়োক্তি—‘ঢেউগুলি নিরুপায়/ ভাঙে দুধারে’

  • উৎপ্রেক্ষা— ‘পরপারে দেখি আঁকা/ তরুছায়া মসীমাখা/গ্রামখানি মেঘে ঢাকা/প্রভাতবেলা’

অলংকারের পাশাপাশি ছন্দ নির্মাণেও তাঁর দক্ষতা প্রশংশিত। এই কবিতায় অকারবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ লক্ষিত।

সমগ্র কবিতাটি চিত্রকল্প খণ্ডিত ; এসেছে গীতিকাব্যিক মূর্ছনাতে। যেমন— 

  • রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা/ভরা নদী ক্ষুরধার/খরপরসা— / কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
  • একখানি ছোটো খেত, আসি একেলা/চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।

আলোচ্য কবিতার একটি রূপকার্য আছে সেটাই এই কবিতার Organized massage. তা হল—আমরা যা সৃষ্টি করি তা মহাকাল বহন করে কিন্তু স্রষ্টাকে মহন করে না। সমালোচক মহলে কবিতাটির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রবীন্দ্রনাথ সমস্ত কিছু নস্যাৎ করে বলেছেন যে এই কবিতার বাহিক্য সৌন্দর্যটাই আসল সেখানে অবশ্য কিছু তত্ত্ব কথা ঢুকে যেতে পারে। তাঁর এ প্রসঙ্গে মন্তব্য— ‘প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে, তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করে গেল অহংটিকেই তার খাজনা স্বরূপ মৃত্যুর হাত দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে—’ (তরী বোঝাই/শান্তিনিকেতন)

সোনার তরী কবিতা সামগ্রিকভাবে কোনো তত্ত্বকথা আশ্রয় করলেও যে ভাষাপ্রতিমা কবি অঙ্কন করেছেন তার সৌন্দর্য অস্বীকার করা হয় না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই কবিতাকে বলেছেন প্রেম কল্পনামূলক রচনা। যাই হোক কবিতার শৈলী নির্মাণে কবির অপূর্ব নির্মাণক্ষম প্রতিভার পরিচয় পাই; তা কবিতার ভাবের সঙ্গে একীভূত এবং সৌন্দর্য স্ফুরনো সহায়ক।

Rate this post